সাগর দর্শন

তিনি লালপেড়ে ধুতি পরেন, জামা পরেন, জুতো পরেন। তক্তার ওপর বিছানায় শোন, আবার মশারিও খাটান"। বিদ্যাসাগর অবাক! "এ কেমন পরমহংস তোমাদের? কোনো ভড়ং টড়ং নেই বলছো?" শ্রীম বললেন, "না। রানী রাসমণির কালীবাড়িতে পুজো করেন, আর সারাক্ষণ ঈশ্বরচিন্তা করেন।"
 
বিদ্যাসাগর হেসে ফেললেন, "আচ্ছা আচ্ছা। তাঁকে নিয়ে আসবে একদিন। এত করে যখন বলছেন।"

ঠাকুর সাগর দর্শন করতে চেয়েছিলেন। এক্ষণে সাগরও ঠাকুর দর্শন করতে চান। শ্রীমর সংবাদে খুশি হলেন ঠাকুর। শ্রীম বললেন "কবে যাবেন? আজ, কালের মধ্যেই?" ঠাকুর যেন ধ্যানমগ্ন কন্ঠে বললেন, "যে কোনো দিন কি আর সাগর দর্শন হয় গো? সাগর দর্শন করতে যাব এই শনিবার। ঠিক বিকাল চারটেয়। ওদিন শ্রাবণের কৃষ্ণাষষ্ঠী। বড় ভালো দিন।

১৮৮২ সালের একটা দিন। বিদ্যাসাগরের বয়স বাষট্টি ছুঁইছুঁই। রামকৃষ্ণ ছেচল্লিশে দৌড়াচ্ছে। সাগর তখন বাদুড় বাগানে থাকেন। ঠিক চারটে বাজতে মিনিট দুয়েক বাকি, একটি ঘোড়ার গাড়ি এসে দাঁড়ালো বিদ্যাসাগরের বাড়ির নিকটে। গাড়ি থেকে নামলেন ভবনাথ, মহেন্দ্রনাথ (শ্রীম), হাজরা ও ঠাকুর রামকৃষ্ণ স্বয়ং। বাড়ির ভিতর ঢুকতেই ঠাকুরের চোখ জুড়িয়ে গেল। কি সুন্দর বাহারি ফুলের গাছ। যেন নিজের অজান্তেই বলে ফেললেন, 'আহা, বিদ্যাসাগরের ভেতরটা ভারি নরম গো।' সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় এলেন তিনি। উত্তরে একটি ঘর, পূবদিকে বিশাল বৈঠকখানা, পাশেই একচিলতে শোবার ঘর। কোনোরকম আভিজাত্যের চিহ্ন নেই। প্রত্যেক ঘরের দেওয়ালে সারি সারি বই! এই এত্তবই লোকটা পড়েছেন? হেসে ফেললেন ঠাকুর। বড্ড বিষন্ন হাসি। "এ তো সবই অবিদ্যা! তিনি কই? তাঁকে জানাই তো আসল। এত পড়েছে লোকটা অথচ সে সেই এক-কে জানেনি।"

বিদ্যাসাগর বসার ঘরেই ছিলেন। এগিয়ে এলেন ঠাকুরকে অভ্যর্থনা জানাতে। মুখোমুখি দর্শন হল, ঠাকুর দেখলেন সাগরকে। আর সাগর দেখলেন ঠাকুর। ঠাকুরই প্রথম কথা তুললেন, "এতদিন কত খাল বিল হদ্দ নদী দেখেছি, এখন সাগরে এসে পড়লুম গো।" বিদ্যাসাগর মহাশয় রসিকতা করে বললেন "এসেই যখন পড়েছেন, নোনাজল কিছুটা নিয়ে যান।" ঠাকুর বললেন "নোনা জল কি গো! তুমি যে ক্ষীর সমুদ্র।"

কথা শুরু হল। পরমহংস পরম আত্মীয়তায় বিদ্যাসাগরের দানধ্যানের প্রশংসা করলেন। বিদ্যার প্রশংসা করলেন। বাহুল্য বর্জিত অনাড়ম্বর জীবনের প্রশংসা করলেন। সাগর সব শুনলেন৷ মনে মনে আনন্দও পেলেন। তার ইচ্ছা হল প্রায় নিরক্ষর এই মানুষটির দৌড় দেখা যাক। ষড়দর্শনে মহাপণ্ডিত তিনি। ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'ব্রহ্ম কি?' ঠাকুর উত্তর দিলেন, "সমস্ত বিদ্যার ওপরে তিনি। বিদ্যা দিয়ে তার নাগাল পাওয়া যায়না"। বিদ্যাসাগর বললেন, "অর্থাৎ...?"

ঠাকুর বললেন, "এ জগতে বিদ্যাও মায়া, অবিদ্যাও মায়া। জ্ঞান ভক্তিও আছে, আবার কামিনীকাঞ্চনও আছে।কিন্তু সার কথা কি জানো? ব্রহ্ম হল নির্লিপ্ত। তিনি যেন প্রদীপের আলো। কেউ সেই আলোর সামনে বসে ভাগবত পড়ে। কেউ আবার আদালতের কাগজ জাল করে। তাতে প্রদীপের কিছু আসে যায়না। তার কাজ আলো হয়ে জ্বলে থাকা৷ ব্রহ্মও কতকটা তেমনই।"
 
বিদ্যাসাগরের চোখে অপার বিস্ময়! শাস্ত্রের কঠিন শ্লোকের এত সহজ ও গভীর ব্যাখ্যা তিনি এর আগে শোনেননি। আবার যার কাছ থেকে শুনলেন তিনি প্রায় নিরক্ষর, এক বামুন ঠাকুর। এও কি সম্ভব? ঠাকুরের থামার বালাই নেই। গড়গড় করে বলে চলেছেন, "শোনো বিদ্যাসাগর, বেদ, পুরাণ তন্ত্র ষড়দর্শন সবই এঁটো। একমাত্র ব্রহ্ম কোনোদিন এঁটো হল না। ব্রহ্ম যে কি আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারেননি।"

বিদ্যাসাগর বাধা দিয়ে বললেন, "কিন্তু বেদে যে..." ঠাকুর হাসলেন। "জানি গো জানি, তোমাদের বেদে কি আছে। বেদে আছে বটে ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ, সচ্চিদানন্দ।"
 
বিদ্যাসাগর যেন দোয়ালা শিশুর মত চমকে উঠলেন! এ লোকটা বেদ ব্রহ্ম কি বলেছে তাও জানে! আশ্চর্য। ওদিকে ঠাকুর বলে চলেছেন, "একজন সাগর দেখতে এলো। তাকে জিজ্ঞাসা করা হল কেমন সমুদ্দুর দেখলে গো? সে বললে আহা! কি দেখলাম। কি হিল্লোল! কি কল্লোল! বেদে যারা ব্রহ্মের সংজ্ঞা লিখেছেন তারাও কতকটা এমনই। শুকদেবই বলো আর যাই বলো, সবাই সেই ব্রহ্মসাগরের তটে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ ব্রহ্মসাগরে নামেনি।

বিদ্যাসাগর আচ্ছন্ন। মোহগ্রস্ত। যেন কোনো জাদুকর সম্মোহিত করেছে তাঁকে। বাহ্যিক কাঠিন্য লুপ্ত। তিনি জানতে চাইলেন "ব্রহ্মজ্ঞান কি পাওয়া সম্ভব?" ঠাকুর বললেন "সম্ভব। তার জন্য সমাধি চাই। কিন্তু সমাধিস্থ হলে বিচার একেবারেই বন্ধ থাকে। কাউকে সেই উপলব্ধির কথা জানানো যায়না। একবার একটা নুনের পুতুল সাগরের গভীরতা মাপতে গেল। যেই সে সাগরের জলে ডুবলো অমনি গলে গেল। তার আর গভীরতা মাপা হল না। ঘি যতক্ষণ কাঁচা ততক্ষণই তার কলকলানি, জমাট ঘিয়ের আর শব্দ কই? শূন্য কলসীতে জল ভরছো ভক-ভক ভক-ভক শব্দ। যেই জল ভর্তি হল আর শব্দ নেই। ব্রহ্ম কতকটা এমনই।

বিদ্যাসাগর জানতে চাইলেন, "ব্রহ্ম আর ভগবান কি এক?" ঠাকুর বললেন, "যিনি ব্রহ্ম তিনিই ভগবান। তবে ব্রহ্ম নির্গুণ, নিরাকার। ভগবান ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ। নিরাকার ব্রহ্মের একা থাকতে ভালো লাগেনা। তাই তিনি সাকার হলেন। এক থেকে বহু হলেন। ব্রহ্ম থেকে ভগবান হলেন।"

বিদ্যাসাগর নীরব। এ কি কথামৃত শুনছেন তিনি! ঠাকুর প্রশ্ন করলেন, "আচ্ছা বিদ্যাসাগর, তুমি তো মহাপণ্ডিত। বলো তো গীতার এক কথায় অর্থ কি হবে?" বিদ্যাসাগর ভাবলেন। এক কথায় গীতার অর্থ? অসম্ভব৷ উত্তরটা ঠাকুর নিজেই দিলেন "গীতা শব্দটাকে পর পর দশবার উচ্চারণ করো। দেখো তুমি উচ্চারণ করছো ত্যাগী-ত্যাগী। হেসে ফেললেন ঠাকুর। এই হচ্ছে গীতার শিক্ষা। সব ত্যাগ করে ভগবানকে চাও। শোনো বিদ্যাসাগর অনেক পড়লেই পণ্ডিত হওয়া যায়না। ভগবানকে ভালোবাসতে শেখো।যতদিন পর্যন্ত 'আমার আমার' করবে জানবে সেটাই অবিদ্যা। আর যেই তুমি ভাববে আমার বলতে কিছু নেই সবই ভগবানের, সবই ঈশ্বরের, জানবে তুমি অবিদ্যা থেকে বিদ্যায় এলে।"

ঠাকুরের বিদায়ের ক্ষণ উপস্থিত। বিদ্যাসাগর আবারও তাকালেন রামকৃষ্ণের দিকে। বিদ্যা-সাগর মিশে গেলেন 'প্রজ্ঞাপারমিতায়'।

[ Kathamrita – Volume 3 Section 1 ]

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ