একটা বিস্কুট

 


একটা বিস্কুট 

দেবপ্রসাদ জানা 


আমি সাধারণত চায়ের দোকানে চা টা খাইনা। বাড়িতে সেদিন আমার মেসো শ্বশুরের ছেলে পিন্টু দা এসেছিল, সে বলল- চলো চা খেয়ে আসি।মোড়ের  মাথায় বৌদির দোকানে চা খেলাম। সাথে দুটো বিস্কুট নিয়েছিলাম,একটা কালো কুকুর অনেকক্ষণ ধরে আমার চারপাশে ঘুরছে দেখে, তাকে একটা বিস্কুট দিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছি। কিন্তু কুকুরটা কিছুতেই যাচ্ছে না,আমি তাড়া দিলাম কুকুরটা চলে গেল, অফিস ফেরতা  প্রতিদিন আমার বেশ রাত হয়,বেলঘড়িয়া থেকে হেঁটে আসতে হয় অনেকটা । সেই দিনের পর থেকে কুকুরটা প্রতিদিন আমার সঙ্গে আসে। কখনো আগে আগে, কখনো পিছু পিছু। ভাবলাম খাবারের লোভে আসে।  তাই স্টেশন থেকে কটা বিস্কুট কিনে ওকে দেই। আর হাঁটতে থাকি। বাড়িতে কথাটা বলতে মা বলল - একটু সাবধানে আসিস,ওসব বিস্কুট টিস্কুট দিস না,তাড়িয়ে দিবি।  রাস্তার কুকুর কামড়ালে চোদ্দটা ইনজেকশন দিতে হবে। পরের দিন থেকে তাঁকে আর বিস্কুট দিই না, তাড়িয়ে দিই। তাও আমার সঙ্গে সঙ্গে আসে। 

একদিন প্রচুর বৃষ্টি,রাস্তা ঘাটে জল জমে গেছে, স্টেশন থেকে নেমে রেল লাইন ধরে হাঁটছি, অন্ধকার,তবু আকাশের আলোয় রেললাইনের পাতা সিমেন্টের থাম্বা গুলোতে পা দিয়ে হাঁটতে পারছি, কোথাও পাথরগুলো থাম্বার উপরে পড়ে আছে,তাতে একবার দুবার হোঁচট খাচ্ছি, কিছুদুর যাওয়ার পর দেখলাম,অামার সঙ্গী পেছন পেছন আসছে, সে কখনো পেছনে যাচ্ছে, আবার দৌড়ে আগে আগে যাচ্ছে। ওদের একটা স্বভাব হল যেখানে যাবে  রাস্তায় হিসি করতে করতে  যাবে। এই ভাবেই ওরা ওদের যাওয়ার পথনির্দেশ দিয়ে যায়।  ফেরার পথে  যাতে ভুল না করে। আজকে আর ওকে তাড়ালাম না। ভাবলাম অনেক অন্ধকার মেঘ ঘন কালো হয়ে রয়েছে। ভয় ভয় করছে, থাক না সাথে। একটু মায়া হলো একটা বিস্কুট যদি আনতাম, কত ভালো হতো,দিতে পারতাম। অবলা জীব,সারাদিন হয়তো কিছুই খায়নি,তাই খাবার পাওয়ার আশায় দৌড়ে বেড়াচ্ছে, এই বৃষ্টিতে আর কে খাবার দেবে?রাস্তাগুলোতে  জল। হয়তো এই রেললাইনেই সারাদিন ধরে ঘুরছে,আমাকে দেখে, দৌড়ে সামনে যাচ্ছে,আবার আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে,

যে সময়ের কথা বলছি,তখন হাতে মোবাইলের চল ছিল না। সঙ্গে লাইট ও নেই।  একটা সিগারেট ধরালাম লাইটটার জ্বালিয়ে,অন্ধকারের ঘনত্ব মেপে নিলাম কতদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, না বেশ অন্ধকার। আরো আধমাইল টাক হাঁটতে হবে, আশেপাশে কোন বাড়ি নেই,ফাঁকা আর জঙ্গল।লাইনের পাশে খালগুলো রাস্তার জলের সঙ্গে সব এক হয়ে গেছে। লাইনের পাশে শেয়াল আছে  বোধহয় । ডেকে উঠলো হুক্কা হুয়া,কুকুরটা ও সঙ্গে সঙ্গে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। যদিও মাঝে মাঝেই কিছু একটা দেখে,ঘেউ ঘেউ করছে।  ছুটছে,বেশ সাহসের সঙ্গে। ছুটে চলেছে আমার সামনে সামনে। নিজেকে মনে হচ্ছে ধর্মরাজ। আরেকটি কুকুর পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে,স্বর্গের দিকে। এই ভাবেই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের পথে,সঙ্গে ছিল কুকুর। স্বর্গ আরোহণের সময়।  এইসব ভাবছি, হঠাৎ একটা জোরালো আলো চোখে পড়ল, ঘেউ ঘেউ করে ছুটে গেল কুকুরটা,লাফ দিয়ে আমার গায়ে পড়লো।  আমি ছিটকে পড়লাম রেললাইনের পাশে কলা গাছের উপর। বুড়ো আঙুলটা বোধ হয়  ভেঙে গেল।  আঙ্গুল ধরে চেপে বসে পড়লাম। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছি না,একটা গোঁগানোর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি,অন্ধকারে কি করবো ভাবছি,এই জঙ্গলে সাপখোপ থাকতে পারে।  উঠে লাইনের উপরে এলাম, দূরে কারা যেন আসছে। আমি উঠে দেখতে চেষ্টা করছি কারা। কিন্তু মাথাটায় চোট লেগেছে বোধ হয়। চোখে ঠিক দেখতে পাচ্ছি না। আধো আলোয় কুকুরটাকে দেখার চেষ্টা করছি কি হলো? কিন্তু কিছুতেই দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় গেল কুকুরটা? যারা আসছিল তারা জি আর পি, আমাকে ধরে বাড়ি নিয়ে গেল। আমি শুধু কুকুরটার খোঁজ করছি।পায়ে খুব ব্যথা। মা গরম জল করে ধুয়ে দিচ্ছে।

মাকে বললাম 

- জানো মা, আজ কুকুরটার জন্য জীবনে বেঁচে গেলাম।

- কোন কুকুর?

- ওই যে, যে কুকুরটাকে বিস্কুট দিতাম, তুমি বারণ করলে।

- ধুর ওই কুকুর আসবে কোত্থেকে?  ওতো আজ সকালে লাইনে কাটা পড়ে মরল।

কি অদ্ভুত তাই না?


Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ