কনে দেখা রোদ
কনে দেখা রোদ
দেবপ্রসাদ জানা
চা,এলো পাত্রীকে সঙ্গে করে,আমি বাবা আর মা পাত্রীকে ছবিতে দেখেছি,তবে ছবির সাথে খুব একটা পার্থক্য নেই। মাথা নিচু করে সামনের চেয়ারে বসল,আমি মাঝে মাঝে পাত্রীর দিকে তাকাচ্ছি আড়চোখে,সেও বোধ হয় তাই করছিল, ফলে তার চোখে চোখ পড়ে গেল একবার। মা জিগেশ করল - নাম কি?
- সুনন্দা বোস।
নামটা বেশ ভালো। গলাটা খুবই নিচু, খুব আস্তে। আমাদের বাড়িতে সকলেই জোরে কথা বলে। এত আস্তে বললে শুনতেই পাবো না। যদিও এটা কনেদেখা স্বর কিনা জানা নেই।
-আমার মেয়ে চাকরি করতে চায়।
মেয়ের মা তন্দ্রা দেবী কথাটা বলে মায়ের দিকে তাকাল।
- তাহলে বিয়ে দেবেন কেন? চাকরি পাক,তারপর নয় বিয়ে দেবেন।
- না মানে বয়সটাওতো হচ্ছে, এরপর ওর বয়সি ছেলে পাওয়া যাবে না। এম এ পাশ করে বসে আছে, কয়েকটা চাকরির পরীক্ষাও দিয়েছে,
- চাকরিটা কি খুব দরকার হবে? বিয়ে যখন চাকরি করার আগেই দিচ্ছেন। যাকে বিয়ে দেবেন সেতো চাকরি করেই। তাছাড়া আপনি কি করে ভাবলেন যার বাড়িতে বিয়ে দেবেন তারা ওকে চাকরি করতে দেবে,
- কিন্তু চাকরিতো ওকে করতেই হবে।
- কেন?
- চাকরি বাকরি না করলে আমাদের বা দেখবে কে? আমার দুই মেয়ে, ছেলেতো নেই, ওর ওপরেই ভরসা,তাই কষ্ট করে হলেও ওকে আমরা এম এ পাশ করিয়েছি, অন্তত একটা স্কুল শিক্ষিকা চাকরি যদি পায়,আপনারা ওকে নিশ্চয়ই চাকরি করতে দেবেন?
পাশ থেকে পাত্রীর দূর সম্পর্কের দিদি বলল,
- চাকরি না করতে দিলে জামাইকেই শ্বশুর শাশুড়ি কে দেখতে হবে,
এবার আমার মুখ খোলা ছাড়া উপায় দেখছি না।
- দেখুন আমার মা একা থাকে, আমি আর বাবা বেরিয়ে যাই, এরপর ও যদি বেরিয়ে পড়ে তাহলেতো -
গরম চায়ে এক চুমুক দিয়ে মা বললো,
- সে নয় বুঝলাম। আগে জামাই হোক, আর বর্তমানে ছেলেরাই বাবা মাকেই দেখে না, জামাই দেখবে তার গ্যারান্টি কে দেবে?
সেই দিদিটি আবার উত্তর করল-
- কেন আমার ভাইয়ের শ্বশুরকে তো আমার ভাই ই দেখে।
পাশে ওনার ছোট্ট ছেলেটি দাঁড়িয়ে ছিল,বয়স বছর দশেক হবে, সে বলল-
দাদু দিদাকে তো দেখেই না,দাদু দিদা কত কান্নাকাটি করে,বাবা মাঝে মাঝে দাদুর হাতে কিছু টাকা দেয়,আমি দেখেছি।
দিদিটি জোর করে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল।
ছেলেটির কথায় মা কান না দিয়ে বলল-
- সে তার মহানুভবতা,মেয়ে চাকরি পেলে নিজের সংসার সামলাবে না,বাপের বাড়ির সংসার সামলাবে সে তার নিজের ব্যপার।
মেয়ের পিসি না কে হয় সে বলল,
- কেন নিজের সংসার কেন? আপনার ছেলেতো চাকরি করে বলে জানি, যদিও এখনো খোঁজ নেওয়া হয় নি, সে যাই হোক আমাদের মত মানুষদের সব মানিয়ে নিতে হয়।
মা বলল-
- দেখুন বিয়েটাতো দুজনের নয়,দুটো পরিবারের। একটু আধটু দেখেই নিতে হয়। এখন কার মেয়েরা লেখাপড়া ছাড়া কিছু শেখে না জানি, ফলে সে সব নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই, যারা সংসার করবে তারা বুঝে নেবে, তবে যতদিন ছেলের বিয়ে না দিচ্ছি ততদিন ছেলে আমাদের, বিয়ের পর কি করবে, সেতো আমরা বলতে পারব না, যদি আপনার মেয়ে চাকরি করে, আর আমার ছেলে যদি তা করতে দেয়,তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই, আমরা বুড়ো বুড়ি ঠিক চালিয়ে নেবো।
কথাটা শুনে মেয়ে বাবা ও মা যেন স্বস্তি পেলেন।
- তাহলে তো কোন সমস্যা নেই,
মেয়ের মা তন্দ্রা দেবী বেশ উৎসাহ নিয়ে কথাটা বলল।
-দেখুন মেয়ে আমাদের পছন্দ, আপনার ও আমার বাড়িতে গেছেন। সব দেখেছেন। আপনাদের বাড়িও দেখলাম, এটাতো নিচতলা। ওপরে কটা ঘর?
- আজ্ঞে এটা আমাদের নিজের বাড়ি না আমরা ভাড়া থাকি,
- ও, তাহলে? এই দুটোই ঘর।
- আজ্ঞে হ্যাঁ,
-তো আপনাদের মাত্র এই দুটোই ঘর? জামাই এসে থাকবে কোথায় ? মেয়ে জামাইকে থাকার জায়গা দিতে হবে তো?
পাত্রীর বাবা বললো, হ্যাঁ সেতো দিতেই হবে, পরে না হয় আরো একটা ঘর...
আমি দেখলাম মাকে। খুশি হলো না দুঃখ পেলো বোঝা গেলো না। তবে মুখে হাসি ভাবটা রাখার চেষ্টা করছে। এবার মেয়ের বাবার দিকে তাকিয়ে মা বলল,
- তা আপনি তো চাকরি করেন, পেনশন আছে নিশ্চয়ই। এতদিন চাকরি করলেন, কিছুতো জমিয়েছেন?
- তা আর হলো কোথায়? ঘর ভাড়া মেয়েদের খাওয়া পরা, এত কিছুর পরে কি করে থাকে বলুন?
- একটা বাড়ি অন্তত করতে পারতেন, এখন শুধু হাতে মেয়ের বিয়ে দিতে আপনাদের কেমন লাগবে? আমিই বা কি করে মেয়েকে খালি হাতে নিয়ে যাবো? আমার আত্মীয় স্বজন কি বলবে?
অন্তত হাতে কানে গলায়,খাট বিছানা,একটা ফ্রীজ, আলমারি, একটু চমকদার তত্ব না নিয়ে গেলে মানুষ কি ভাববে?
এরপর খানিকক্ষন সকলে চুপ। নীরবতা ভেঙ্গে আমার মা বলল-
এবার বলুন আপনাদের তরফ থেকে কি করার আছে?
- দেখুন আপনি তো জানলেন সব। আমাদের কোন মজুত টাকা নেই, যা করব সব অফিস থেকে লোন নিয়ে, বেশি লোন ও পাবো না, রিটায়ারের সময় হয়ে গেছে।
-মেয়ের জন্য কিছুতো রেখেছেন।
মেয়ের মা এবার বললো,
-না রাখা হয়নি, তাছাড়া আমার আর একটি মেয়ে আছে।
- তাহলে আর কি,সবই যখন ছোট মেয়ের জন্য রাখবেন। বড় মেয়েকে কিছু দেবেন না,
আমি বুঝতে পারছিলাম না মা হঠাৎ করে এরকম বদলে গেল কি করে? এইতো সেদিন বলল আমার কিছু চাই না, একটা ভালো বৌমা হলেই চলবে।
মা আরো বলল-
আমাদের বাড়িটাতে তিনখানা বাথরুম আছে, বাসন মাজার লোক আছে, ঘরের সব কাজ করার জন্য সবসময়ে একটা মেয়ে থাকে, এর পরেও ছেলের বিয়েতে কিছু নেবো না তা কি করে হয়?
আমাদের বাড়ি গায়ে আপনার মেয়েকে কিছুই করতে হবে না, বাথরুমে কোমর ভেঙে বসতেও হবে না। সব বাথরুমে কোমট লাগানো। এর পরেও যদি বলেন কিছু দিতে পারব না, তাহলে তো এই সম্বন্ধ শেষ পর্যন্ত হবে না।
মেয়ের মা বলল-
আমাদের বাথরুম ওই একটাই, তাতে কোমট বসানো নাই,এতে আপনার ছেলে যেতে পারবে তো?
বুঝলাম ভদ্রমহিলা ভেতরে ভেতরে খুব রেগে গেছেন।
মা বললো, হুম,তা তো পারবে, আমার ছেলে এত মর্ডান এখনো হয়নি,কোমট ছাড়া চলবে না।
মেয়ের পিসি কচুরিটা শেষ করে বললো,
আমার ছেলের কিন্তু কোমট লাগে। আসলে ওর ছোটবেলার অভ্যেস।
এবার প্রশ্ন এলো আমার দিকে,তা তুমি কোথায় চাকরি করো বাবা ?
বললাম, আবগারি,
ভদ্রমহিলা রসগোল্লা মুখে পুরে বললো,
বাহ্, তা তুমি তো ভালোই চাকরি করো, বেশ উপরি কিছু আছে, টাকা পয়সা বেশ জমিয়েছ তাই না?
বললাম, উপরি ব্যপারটা এখন আর নেই।
মেয়ের মা বলল-
ওসব কথা ছাড়ো না ঠাকুরঝি।
মা আমার হবু বৌকে বলল,
-তোমার চাকরি করার দরকার নেই। ঘরের বৌ রোজ ট্রেনে বাসে ঠেলা খেতে খেতে অফিস যাবে,
সেটা কেমন করে মানি আমরা।
মেয়ে চুপ করে সব শুনছে,
মেয়ের মা বলল-
-একটু চেষ্টা করলে কিন্তু আমার মেয়ে চাকরি পেয়ে যাবে।
মা বলল,
- পেয়ে যাবে ঠিক কথা,সেটা যদি আমাদের প্রয়োজনে লাগত তবে নয় দেখতাম। সবই তো আপনারা আপনাদের জন্য বলছেন।
বাবা এতক্ষন চুপ করেই ছিল, মনযোগ দিয়ে একটার পর একটা মিষ্টি খাচ্ছিল, এবার একটা চিকেন প্যাটিস চিবোতে চিবোতে বলল,
- আমাদের বাড়ির বৌয়েরা চাকরি করে না। এখন তুমি যদি...
মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বাবা আবার খাওয়াতে মন দিলো।
- তুমি গান জানো ?
মেয়ে বলল, না
মেয়ের বাবা বললো, ও ভালো নাচতে পারে। কতো পুরস্কার...ওই যে দেখুন...
মা চিকেন রোলটা শেষ করে বলল,
বাড়ির বৌ পায়ে ঘুঘুর পরে ধেই ধেই করে নাচানাচি করবে, পাড়ার লোকে জানলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারবে,সে চলবে না। বরং তুমি যদি একটু আধটু গান জানো,একটা গান গাও...
আমি মা-বাবার মুখের দিকে তাকালাম। মা বললো, "পুরানো সেই দিনের কথা"টা জানা আছে? তাহলে গাও শুনি।
বাবা রাবড়ি এক চামচ মুখে নিয়ে বললো,
মেয়ে আমাদের পছন্দ। তা বিয়েতে আপনারা কী কী দিতে পারবেন? সেটা বলুন অনেক রাত হলো এবার বাড়ি যেতে হবে।
মেয়ের বাবা হাত কচলাতে কচলাতে বললো,
আপনারা কি চাইছেন বলুন? আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব।
মেয়ের মা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-তোমার কি মতামত বাবা?
আমি বললাম, কিছু মনে যদি না করেন বলছি যে, আপনার মেয়ে কী নিয়ে এম এ করেছে?
উত্তর এলো, বাংলায়,
বললাম, ও কিন্তু আমি তো সাধারণ বি এ পাশ করেছি, চাকরিটা কপাল জোরে পেয়ে গেছি। এমত অবস্থায় আপনার মেয়ে কি আমাকে বিয়ে করতে রাজি আছে?
- না -
মেয়ের জোরালো উত্তর এল।
বাবা সবে রাবড়ির চামচটা মুখে ঢুকিয়ে ছিল, সেটা মুখেই থেকে গেল, মা উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে,
- দেখুন অনেকক্ষন আপনাদের অনেক কথাই শুনছি, আমার এ বিয়েতে মত নেই।
মা বলল,
- ভেবে দেখো,আমার ছেলের মতো আর পাবে না।
- আমি গান গাইতে পারি না, নাচতে পারি ওটাই আমি শিখেছি, আপনার ছেলের কি গুণ আছে আমার বাবা কি জিগেশ করেছে? আমি চাকরি করতে যদি না পাই তাহলে পড়াশোনা করলাম কেন? ছেলেরা পড়া শোনা করে চাকরি করে,বাবা মাকে দেখতে পারে, মেয়েরা করবে না কেন? আপনার ছেলের লেখাপড়াটা লেখা পড়া,আমার লেখাপড়া লেখা পড়া নয়? আমি বাবা মাকে দেখতে পারব না?
মেয়ের বোন বললো, বললি যখন একটু আগে বলবি তো দিদি। খাবারগুলো বেঁচে যেত তাহলে।
আমার মা হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল।
- সত্যি তো একটু আগেই বলতে পারতে তাহলে এত গুলো খাবার বেঁচে যেতো।
Comments
Post a Comment