অদিতি

 অদিতি


- কেমন আছো গোবিন্দ?

গোবিন্দ সম্পর্কে আমার দূর সম্পর্কের ভাই হয়। বহুদিন কোভিট নাইনটিনে ভুগে সবে বাড়ি ফিরেছে। চারমাস, আই সি ইউ, অক্সিজেন, সকলে ভেবেছিলাম ও আর বাঁচবে না। যমে মানুষে টানাটানি। বেশিদিন আর বাঁচবে না। এরকম অবস্থা, সেই গোবিন্দ আজ বিয়ে করতে যাচ্ছে।

-তোমার বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে গেছে?

- হ্যাঁ 

- কবে হলো? জানলাম না কিচ্ছু। আমাকে একবার বলতে পারতে?

- বলতাম, কিন্তু সত্যিই বিয়েটা হবে কিনা, সেটাই তো জানা ছিল না। আমার বোনাই ঠিক করেছে। বাড়ির সকলের পছন্দ। বোনাই এর বাড়ির পাশে। তারই কেমন আত্মীয় হয়। 

- ও তা ভালো। তোমার শরীর তাহলে এখন ঠিকই আছে। 

- আছে, কিন্তু খুব দূর্বল। খাওয়া দাওয়া ভালো করতে বলেছে।

- আর তোমার অদিতি একের পর এক সম্বন্ধগুলোকে নাকচ করে দিচ্ছে যে ।

- অদিতির সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই দাদা। 

- তাহলে পিতৃহারা ওই মেয়েটার কি হবে? 

- কি হবে তা আমি কি করব? 

- ওর মা কত চোখের জল ফেলেন। তোমার তো কোন কিছু অজানা নয় গোবিন্দ।

- ও চোখের জলের কোনো দাম নেই।

- এতটা স্বার্থপর তুমি? দিনের পর দিন তুমি ওদের বাড়িতে সমস্ত সুযোগ নিয়েছ। হোস্টেলের বদলে ওদের বাড়িতে থেকেছ। ওর মা তোমাকে রান্না বান্না করে খাইয়েছে। সব ভুলে গেছো? 

- তাতে কি? তার জন্য আমি উপযুক্ত ভাড়া দিয়েছি। 

- পয়সাটাই কি সব গোবিন্দ? ভালোবাসার কোন দাম নেই? 

- ভালোবাসা ! কিসের ভালোবাসা? থেকেছি খেয়েছি তার সব মিটিয়ে এসেছি। 

- তা বলেই কি চলে? আমরা নিজেদের সুখের কথা ভাবি। অন্যের দুঃখটাকে দেখতে পাই না।

- এটা কি তুমি আমাকে শোনাচ্ছো? 

- তুমি শুধু তোমার করোনা হওয়ার আগের কথা ভাবো, মনে পড়বে ওদের স্বার্থ ত্যাগের কথা। যে বোনাই এর কথায় আজ বিয়ে করতে যাচ্ছ, সেই বোনাই ই ঘরে ঢুকতে দেয়নি। মাঝ রাতে তোমাকে ঘুরে চলে আসতে হয়েছিল, ওইখানেই। তোমার যত রকমের আবদার, প্রয়োজন সব মিটিয়েছে ওরা, মা মেয়ে মিলে, 

- আমি যদি অদিতিকে বিয়ে করি, মা আমাকে ঘরে ঢুকতে দেবে না। 

-আমি তোমাকে অনুনয় করে বলছি, এ কাজ তুমি করো না। তোমার জন্য ওরা আজ এক ঘরে, পাড়ার লোক কম বদনাম করেনি? তাও তোমাকে ওরা ফেলে দেয়নি, ডাক্তার কবিরাজ হাসপাতাল কি করেনি ওরা, সব তুমি জানো। রাতের পর  রাত হাসপাতালের বাইরে মা মেয়ে অপেক্ষা করেছে, কখন তোমার একটু ভালো খবর শুনবে। 

-মা বললো বাবু, ভালো সম্বন্ধটা হাতছাড়া করিস না । বড়লোকের একমাত্র মেয়ে, প্রচুর দেবে বিয়েতে । তাছাড়া বাবা ও মায়ের অবর্তমানে সব সম্পত্তি মেয়েই পাবে।

-তাহলে কেন অদিতিকে এতদিন প্রেমসাগরে ভাসলে?

- এমন প্রেম সকলেই করে, আবার ভুলেও যায়। 

- তাহলে এতদিন,এত অধিকার কেন ফলাতে?

- অধিকার? কিসের অধিকার? আমাকে ওরা কম যন্ত্রণা দেয়নি? দিনরাত এটা ওটা,বাড়ির চাকরকেও এমন করে না? তাও দিনের পর দিন আমি সহ্য করেছি।

হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির কাছে চলে এলাম। গোবিন্দের এই মনোভাব আমার কিছুতেই ভালো লাগেনি। আজ গোবিন্দ যাই বলুক, যেভাবে অদিতিরা ওকে সাহায্য করেছে, তার প্রতিদান ও দিল না। কিন্তু গোবিন্দ তেমন ছেলে না, কেন যে এমন করছে ও, কদিন বাড়িতে গিয়ে সব ভুলে গেল, বুঝতে পারছি না অদিতির কি গতি হবে, আমার সঙ্গে দেখা হলেই তো কাঁদবে, তাই ওদের বাড়ি যেতে সাহস পাই না। আমি গোবিন্দদের বাড়ির পাশের একটা ছেলের থেকে খবরটা পেলাম। আর পেলাম বলেই গোবিন্দর এই বেইমানিটা বোঝা গেল। আমি ওকে নিজের ভাইয়ের থেকেও ওকে ভালোবাসতাম। সেই ভালোবাসাটা আজ ফুরিয়ে গেল। 

অদিতি লাইফগার্ড নার্সিংহোমে নার্স এর কাজ করে, একবার ভাবলাম বাড়িতে যাবো না ওখানেই কথা বলে আসব, ওখানে গিয়ে জানলাম পাঁচ ছদিন ধরে অদিতি আসছে না, আসবে কি করে, গোবিন্দর এই ব্যবহার সহ্য করতে পারছে না অদিতি। বাধ্য হয়েই ওদের বাড়ি মুখী হলাম। কিন্তু সেখান থেকেও নিরাশ হয়ে ফিরতে হলো। দরজায় তালা বন্ধ। আশেপাশের লোকও কেউ কিছু বলতে পারল না।  কি করি? ওই ব্যাপারের ইতি টেনে, নিজের কাজটা মন দিয়ে করতে লাগলাম। মাসখানিক পর গোবিন্দ এসে নিমন্ত্রণ করে গেল। বিয়ের দিন ওর সাথে যেতে হবে । আমাকেই সব করতে হবে। বিয়েরদিন সকাল থেকেই মনটা খারাপ। অদিতিদের কোনো খোঁজ পাইনি। 

বিয়ের দিন আগত, আমার যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই, গোবিন্দর এই বেইমানি কিছুতেই যেন সহ্য করতে পারছি না। 

যাবো না যাবো করে বিয়ে বাড়িতে পৌঁছলাম সন্ধের সময়। ওদের গ্রামেই বিয়ে। গ্রাম শুদ্ধু নিমন্ত্রন। লোক গিজগিজ করছে, বাচ্চাকাচ্চায় ভর্তি। বিয়ে বাড়ির সামনে নামলাম, গোবিন্দর ভাই সঙ্গে করে নিয়ে গেল ভেতরে,গোবিন্দ ধুতি পাঞ্জাবী পরে শান্তশিষ্ট বরটি সেজে বসে আছে, আমার দিকে তাকাচ্ছেও না। বড় কষ্ট হচ্ছে অদিতির জন্য। আহা রে বেচারী কত আশা করেছিল। 

আর কিছু কররার নেই, শুধু শুধু মন খারাপ করে, লাভ নেই, বিয়েতে যখন এসেই পড়েছি। গোবিন্দর দিকে একটু এগিয়ে গেলাম, ও আমাকে এড়িয়ে চলে গেল। বারে নিমন্ত্রণ করে এলি এখন কথা বলছিস না। আমি মনে মনে খুব রাগ করলাম। ভাবলাম আজই চলে যাবো, কিন্তু উপায় নেই, এই রাতে আর গাড়ি পাবো না, মন মরা হয়ে বাইরে একটা সিগারেট ধরিয়ে, কি করব ভাবছি, একবার মনে হলো যাই,মেয়েটাকে দেখে আসি। কার সাথে গোবিন্দ বিয়ে করছে, তারপর মনে ধুর কি হবে? কাল সকালেই চলে যাবো। 

বিয়ে শুরু হয়ে গেছে। হইহই করে সকলে বিয়েতে আনন্দ উপভোগ করছে, আমাকে কেউ ডাকার ও প্রয়োজন বোধ করেনি, 

গোবিন্দর বোনাই খুব ব্যস্ত, সব ওই সামলাচ্ছে। মেয়ের দিক বরের দিক, গোবিন্দর বউটাকে একবার দেখার ইচ্ছে ছিল। না থাক অযথা মন খারাপ করে লাভ নেই। কাল সকাল হলেই চলে যাবো। গোধূলি লগ্নে বিয়ে, শেষ হয়ে এলো বোধ হয়, স্ত্রী আচার চলছে, চেঁচামেচি শুনতে পাচ্ছি। রাত এগারটা পর্যন্ত এখানেই কেটে গেল, একটার পর একটা সিগারেট খেয়েছি আর চা, টিফিনটা একটা ছেলে দিয়ে গেছিল। রাগ হলেও ওটা খেয়েছি। এখানে এসে এই ব্যবহার পাবো বুঝিনি,মার্চের মাঝামাঝি,ঠান্ডা বেশি নেই, গ্রাম বলে একটু ঠান্ডা লাগছিল, তবে বিয়ে বাড়ির ভেতরে তেমন ঠান্ডা নেই। গোবিন্দদের বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার ভেতরে বিয়ে হচ্ছে ওর বোনাইদের বাড়ির কাছে। কে একটা ছেলে বারবার আমাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে চা দিচ্ছে সেই, লোক প্রায় ফাঁকা হয়ে এলো, এবার বর বউ খাবে, ডাকাডাকি চলছে, ধুতি পাঞ্জাবী পরা গোবিন্দ কে আসতে দেখলাম। 

- কি রাগের চোটে আমার বিয়েটাও দেখলে না?আমার বউকেও দেখলে না। এবার চলো তিনজনে মিলে খাই। আমার বউকেও দেখতে পাবে, 

রাগ হলেও ওর খুশীর মুহূর্তটাকে নষ্ট করব না ভেবে উঠলাম খাবার জন্য, সিটে বসেছি, গোবিন্দর নতুন বউকে সব ধরে ধরে আনছে, এসে গোবিন্দর পাশে দাঁড়াল, গোবিন্দ তার বউকে বলল 

- নমস্কার করো, এটা কে? নিশ্চয়ই তোমাকে চিনিয়ে দিতে হবে না।

- না, এনাকে আমি চিনি, সাজগোজের জন্য একটু অচেনা লাগলেও অদিতিকে চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল হয়নি আমার। 

আমার মুখ থেকে একটাই শব্দ বেরল- অদিতি !


Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ