একটি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন
একটি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন
বাসুর ঘর ঠিক আমার বাড়ির পেছনের বস্তিতে। বাড়ির পেছনে একটা উঁচু ইটের দেয়াল,তারপর একটা বড় নর্দমা,তার পাশে বস্তি,কারো আধা ইটের,কারো দরমার বেড়ার, কারো আধা অ্যাডবেস্টর, কারো টালি, এই দিয়ে মোটামুটি গোটা চল্লিশেক ঘর বারান্দা, তাতে দুশো জনের মত থাকে ওই বস্তিতে। বাসুর বাবা-মা কেউ নেই দুজনেই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। কেন তা আমি জানি না, বছর চারেক আগে,আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, ওই বস্তির একদিকে বড় একটা লেক। আরেকদিকে বড় একটা ঝোপঝাড় ভরা মাঠ। প্রাচীর ঘেরা। রাতের বেলা সেখানে শিয়াল ডাকে,শীতে পরিযায়ী পাখির ভিড় হয়। আমি আর মা ওখানে অনেকবার গেছি,পরিযায়ী পাখির সৌন্দর্য দেখতে, ওই বস্তির লোক সেখানে পাখি মেরে বাংলা মদের চাট বানিয়ে খায়।
সকাল থেকে ওই বস্তিতে শুরু হয়,লোকের বাড়ি কাজে যাওয়ার তাড়া, বাসু রাজমিস্ত্রি জোগাড়ে কাজ করে। সারাদিন সিমেন্ট বালির কাজ করে । আর বিকেলে ফিট বাবু হয়ে ঘুরে বেড়ায়। বেশ ফুটফুটে ছেলে। তাকে দেখে সবারই ভালো লাগবে, আমারও ভালো লেগেছিল, ভালোবাসা কি না জানিনা। তবে ভালো লাগে, বেশ মিষ্টি কথা বলে, আরো একটা গুনছিল বাসুর। ভালো গান করতে পারে, কিশোর কুমারের গান। প্রতি বছর সরস্বতী পুজোর সময় বাসু গান করে।
মা আমাকে জোর করে গান শেখাতে নিয়ে যায় কিন্তু আমার গান হবে না,আমি জানি তবুও মা নিয়ে যায়। আমার গান শুনতে ভালো লাগে, গান করতে ভালো লাগে না,মাকে অনেকবার বলেছি, কিন্তু মানতে চাইনি। আমি বাড়ির এক মেয়ে, মা ছোটবেলায় গান শিখতে চেয়েছিল,হয়নি,তাই আমাকে দিয়ে সাধ পূরণ করতে চায়,প্রতি শনিবার গান শিখতে যাই,বাসু গানের স্কুলের সামনে চায়ের দোকানে বসে থাকে।আমার দিকে তাকায় আমিও দেখি,মা আমাকে বারণ করেছিল কিন্তু আমি শুনিনি।
কোন কোন শনিবার বাসুকে না দেখতে পেলে মন খারাপ হয়ে যেত।
একদিন খুব বৃষ্টি চারদিকে জল জমে গেছে আমি গান শিখতে যেতে পারলাম না,মনটা খারাপ হয়ে গেল,মা বলল ঘরে বসেই গান কর। অনিচ্ছা সত্বেও গানে বসলাম। সন্ধ্যেবেলা মা সন্ধ্যে দিতে উপরে ঠাকুর ঘরে।
আমি নীচের ঘরে বসে আছি। গান শুরু করিনি। মা চিৎকার করে গান করতে বলছে,আমার মন চঞ্চল হচ্ছে,জানলা দিয়ে উঁকি ঝুঁকি মারছি যদি বাসুকে দেখতে পাই। বাসু কোনদিন আমার সঙ্গে কথা বলেনি,শুধু দেখেছে হয়তো ভয়ে বলেনি। আমার বাবাকে পাড়ার সকলে ভয় করে,সকলে তার কথা মানেও,কেন ভয় করে আর কেন মানে তা জানি না। কিন্তু বাবাকে দেখে আমি কোনদিন ভয় পাইনি,আসলে ভয় পাওয়ার মত কিছু পাইনি আমি, বাসু কেন ভয় পায় আমি তাও জানিনা।
এইভাবে কেটে গেল কয়েকটা বছর। মাধ্যমিক দেবো পড়ার খুব চাপ, রাত দিন পড়াশুনা করছি, সকাল-বিকেল রাত শুধু পড়া টিউশন আর বাড়ি, স্কুলে যাওয়ার থাকলে,বাসে যাই, এই বয়সে বাবা-মা মেয়েদের বেশি সাবধানে রাখে, চোখে চোখে রাখে, বড় বিরক্ত লাগে,আমার বিরক্ত লাগলে কি হবে,ভালো লাগে ভাবতে,আমার জন্য বাবা-মার এই পরিশ্রম,সকলের কপালে জোটে না। অনেকদিন বাসুকে দেখিনি তাই মনটাও চঞ্চল ছিল, একটা বছর গান করে না চাইলেও গানের গলাটা আমার ভালোই খুলেছে,একটু-আধটু এখানে-ওখানে অনুষ্ঠানে গানটান করি, সরস্বতী পুজোর চাঁদা নিতে এল বস্তির ছেলেগুলো,
- বৌদি আমাদের ফাংশনে একটা গান করে দেবে? তাহলে নামটা লিখে নেব।
আমার মাকে ওরা বৌদি বলে ডাকে,মা গানের কথা শুনলেই,এক কথায় রাজি হয়ে যায়। এ ব্যাপারে মা আমার অনুমতির প্রয়োজন বোধ করে না। ঠিক হলো আমি উদ্বোধনী সংগীতটা গাইবো।হলুদ শাড়ি পরবো,কিন্তু সমস্যা হল মায়ের ব্লাউজ আমার হয় না,তাই একটা ব্লাউজ কিনতে হবে। সেটা মা সেলাই করে দেবে,সকালে বাড়িতে পুজো দিয়ে স্কুলে চলে গেলাম,এই একটা দিন আমাকে বাবা-মা ছেড়ে দেয়,বন্ধুদের সঙ্গে মনের মত ঘুরে বেড়াই,খুব আনন্দ করি,স্কুলে খাওয়া দাওয়া থাকে। ফিরতে ফিরতে চারটে বেজে গেল, দেখি বাসু রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে, আমিও চেষ্টা করলাম, কিন্তু মা এসে গেল। আমার জন্য মা দাঁড়িয়ে ছিল, তখনো ফোনের ব্যবহার এত শুরু হয়নি, মা বলল ঘুমিয়ে নে, ঘুরে ঘুরে চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে,আমার ঘুমোতে ভালো লাগছে না। তবুও শুয়ে পড়লাম,ক্লান্তির জন্য ঘুমিয়ে পড়লাম। দরজায় বাসু এসে ডাকছে। সুতপা ওঠো তোমার গানের সময় হয়ে গেছে,ওরা দাঁড়িয়ে আছে উঠে পড়লাম। বাসুর সামনেই সব খুলে হলুদ শাড়ি পোরে ফেললাম। আমি বাসুর সামনে সব খুলে শাড়ি পরলাম কেন? মা কোথায় গেল? বাবা কোথায় গেল? কেউ নেই কেন বাড়িতে? আমিই বা ওর সামনে সবকিছু করলাম কেন? বাসু চা করে আনল,আমি সেটা খেয়ে নিলাম,আমার মাথা কিছু কাজ করছে না,কি হচ্ছে এসব, মা কোথায়?বাসুর কি করে এত সাহস হলো আমাদের ঘরে ঢোকার। আমার সবকিছু ও কি করে করে দিচ্ছে? আমি আয়নার মুখ দেখতে গিয়ে চমকে উঠলাম, আমার কপালে সিঁদুর। আমিও সিঁদুর কৌটো থেকে সিঁদুর নিয়ে সিঁথিতে দিলাম, বেশ আঁটোসাঁটো করে শাড়ি পরলাম,উদ্বোধনী সংগীত গাইতে হবে । আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বেশ কিছুটা ঘুরে যেতে হয়। খানিকটা মেইন রোড পড়ে, বস্তিতে যেতে হলে। বাসু বাইক বের করল,বসলাম তাতে বিনা দ্বিধায়, বুঝতে পারছিলাম না বাসুর সঙ্গে কেন যাচ্ছি? মা কেন যেতে দিল, বাবাই বা কোনো বাধা দিল না কেন? হঠাৎ একটা লরি এসে বাইকে ধাক্কা মারলো। বাসুর মাথাটা থেঁতলে দিয়ে চলে গেল, আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম,ছিটকে পড়লাম ফুটপাতে, হাতের দুই জায়গায় ছিঁড়ে গেল, জ্বালা করছে আমি হয়তো অজ্ঞান হয়ে গেলাম, এই অবস্থায় আমি সব দেখতে শুনতে পাচ্ছি। কোথায় থেকে মা এসে আমাকে ডাকতে লাগল। আমি উঠতে চাইছি,উঠতে পারছি না।মা আমাকে একটা ঠেলা মারলো,আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়লাম।
-এই সুতপা সন্ধ্যে হয়ে গেছে। উঠে পড়, পড়তে বসবি না, জানিস ওদের ফানসান বন্ধ হয়ে গেল।
- কেন গো মা?
- ওই বাসু বলে যে ছেলেটা ছিল না, সে বাইক একসিডেন্ট করেছে। মাথাটা থেঁতলে গেছে লরীতে।
আমি হাঁ করে সব শুনলাম,ভেতরটা কেঁপে উঠল।
Comments
Post a Comment