মিষ্টি

ইতিহাসের হাজার নথি ঘাঁটলেও এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। তবে ইতিহাস এটা অবশ্যই বলে যে, বাঙালি জাতির বিশ্বজোড়া প্রসিদ্ধি রয়েছে তাঁর রসনার জন্য। সেজন্যই, প্রাচীন বঙ্গের বাঙালি নারীরা, ‘৬৪ রকমের ব্যঞ্জন’ ও হরেক রকম মিষ্টান্ন বানাতে জানতেন। অতীতে, উত্তর ভারতের শ্রেষ্ঠ মিষ্টান্ন ছিল ‘ক্ষীরের তৈরি লাড্ডু’। সেই ‘লাড্ডু’ ছাড়া, ‘বিহার’ ও ‘উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশের’ মিষ্টান্ন ছিল ‘ক্ষীরের তৈরি প্যাঁড়া’। অতীতে, উত্তর ভারতে ছানার তৈরি মিষ্টান্নের কোনো বালাই ছিল না এবং বর্তমান সময়েও বিশেষ নেই। ছানার তৈরি মিষ্টান্ন বঙ্গদেশেরই বৈশিষ্ট্য। 

বাঙালিদের ছানা তৈরি করার শিখন পদ্ধতি
যদিও বাঙালি ছানা তৈরি করা শিখেছে পোর্তুগিজদের কাছ থেকে, তবুও অতীতে ছানা দিয়েই হরেক রকম মিষ্টান্ন তৈরি করতেন বাঙালি নারীরা। এ ছাড়া তাঁরা ক্ষীরের, ময়দার, নারকেলের ও ডালবাটার মিষ্টান্নও তৈরি করতেন।

ময়দা দিয়ে তৈরি মিষ্টি
 সেই সময়, বাংলার ঘরে ঘরে সেগুলো তৈরি হত। পুরানো  kolkata-য় ময়দা দিয়ে তৈরি মিষ্টান্নের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল -- ‘জিভেগজা’। 

ক্ষীর দিয়ে তৈরি মিষ্টি
ক্ষীর দিয়ে তৈরি খাবারের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল -- ‘ক্ষীরের পুতুল’।

নারকেল দিয়ে তৈরি মিষ্টি
আর নারকেল দিয়ে তৈরি খাবারের মধ্যে বিখ্যাত ছিল -- ‘চন্দ্রপুলি’ ও ‘নারকেল নাডু’।

পুরানো kolkata-র মিষ্টির দোকানের হাল-হকিকত
অতীতে, ‘জিভেগজা’টা সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে খুব প্রিয় একটা খাদ্য ছিল। বিংশ শতকের শুরুর দিকের কলকাতায়, মিষ্টির দোকানগুলো থেকে, এক পয়সা মূল্যে চারখানা ‘জিভেগজা’ কিনতে পারা যেত, সেগুলোর সঙ্গে আবার কিছু ‘বোঁদে’ ‘ফাউ’ হিসেবে দেওয়া হত। সেই সময়, ছানা দিয়ে তৈরি খাবারের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মিষ্টান্ন ছিল ‘সন্দেশ’। পুরানো kolkata-র সন্দেশের দোকানগুলোর মধ্যে কোনটা সবচেয়ে প্রাচীন -- সেটা বলা কঠিন। বিংশ শতকের শুরুর দিকের kolkata-র  প্রতি পাড়াতেই অন্তত একটা করে সন্দেশের দোকান দেখা যেত। সেই সময়ের কলকাতার, ‘নতুন বাজারে’ ‘মাখন ময়রা’র সন্দেশই ছিল সবথেকে চমৎকার। সেই দোকানে কেবলমাত্র সন্দেশই বানানো হত। কড়া ও নরম দু-রকম পাকেরই।

 'আনন্দবাজার পত্রিকা'-র বিবরণ
 ’৮০-র দশকের ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য়, জনৈক ‘জীবনতারা হালদার’, পুরানো kolkata-র মিষ্টি নিয়ে একটি প্রবন্ধে স্মৃতিচারণ করে লিখেছিলেন, “আমাদের ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকো ছিল মিষ্টির জন্য বিখ্যাত। এখনকার মতো তখন অলিগলিতে মিষ্টান্নের দোকান ছিল না। জোড়াসাঁকো অঞ্চলে দোকান ছিল দশ- বারোটা। সে সময় ময়দার মিষ্টিরই বেশি চল ছিল। ময়দার মিষ্টির মধ্যে আবার বেশি চলত ‘গজা’ ও ‘মতিচুর’। ছাতুবাবুর বাজারে ছিল সবথেকে বড় ছানাপট্টি। দরমাহাটা স্ট্রিটেও ময়রাপট্টি ছিল। সেখানে বিখ্যাত ছিল নাথ ময়রার কাঁচাগোল্লা। বউবাজারে নবকৃষ্ণ গুঁই-এর ছানার পোলাউ, পান্তুয়া, দরবেশ ও বোঁদের স্বাদ ছিল সুন্দর। পান্তুয়া পরে রূপান্তরিত হয় লেডিকেনিতে। লর্ড ক্যানিং একবার মুর্শিদাবাদ পরিদর্শনে যান। মুর্শিদাবাদের সেরা ময়রা তাঁর জন্য দশসেরি পান্তুয়া বানালেন। উপহার দিলেন লেডি ক্যানিং-এর হাতে। সে থেকে লোকেরা মিষ্টিটার নাম দিল ‘লেডিকেনি’। তারপর কলকাতাতেও লেডিকেনি তৈরি হতে লাগল।” কিন্তু পরে কলকাতা প্রসিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল তার রসগোল্লার জন্য। আজও বাঙালি মাত্রেই রসোগোল্লায় মজে যায়। সারা পৃথিবী জুড়ে রসগোল্লার পরিচিতি রয়েছে এবং বাঙালিয়ানার সাথে এই মিষ্টিটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এই পৃথিবী বিখ্যাত মিষ্টিটির আবিষ্কারক ছিলেন ‘নবীন চন্দ্র দাস’৷ নবীন কলকাতায় তাঁর প্রথম মিষ্টির দোকানটি দিয়েছিলেন -- জোড়াসাঁকোর ‘মাথাঘষা গলি’-তে। সেই দোকান না চলায়, পরে তিনি আর-একটা দোকান করেছিলেন, বাগবাজারে, ‘আপার চিৎপুর রোডের’ ওপর, ‘শক স্ট্রিটের’ ঘোড়ার ট্রাম ডিপোর কাছে। সেখানেই নবীন প্রথম তাঁর রসগোল্লা সৃষ্টি করেছিলেন। তবে ‘নবীনচন্দ্র দাস’ কবে রসগোল্লার আবিষ্কার করেছিলেন? এক সময় নবীনের রসগোল্লা আবিষ্কারের সালটি নিয়ে ঐতিহাসিক ও খাদ্য গবেষকদের মধ্যে তুমুল বিতর্ক ছিল -- ১৮৬৮ সাল নাকি ১৮৮০ সালের পরে? একদলের মতে, যেহেতু ‘কলকাতা ট্রামওয়েজ কোম্পানি’, বাগবাজারে ট্রাম চালাবার জন্য ‘কলকাতা করপোরেশনের’ সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল ১৮৭৯ সালের ২রা অক্টোবর তারিখে, তাই এর থেকে প্রমাণিত হয় যে -- ‘নবীন’, রসগোল্লা আবিষ্কার করেছিলেন ১৮৮০ সালের পরে। কিন্তু পরবর্তীকালের গবেষণায়, রসগোল্লার আবিষ্কার যে ১৮৮০ সালের পরে হয়েছিল -- এই তথ্য ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

'বর্তমান পত্রিকা'-র বিবরণ
 ‘নবীন’ যে ১৮৬৮ সালেই রসগোল্লার আবিষ্কার করেছিলেন, সেটা প্রথম, ১৯৮৮ সালের ১১ই এপ্রিল তারিখের ‘বর্তমান’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে। ‘গৌতম হোড়’ নামের এক অখ্যাত খাদ্য গবেষক প্রথম জানিয়েছিলেন। সেই প্রবন্ধে তিনি স্পষ্টভাবে লিখেছিলেন -- “নবীন চন্দ্র দাস রসগোল্লা সৃষ্টি করেছিলেন ১৮৬৮-তে।” নবীনচন্দ্র দাসের পূর্বপুরুষরা ছিলেন চিনির ব্যবসায়ী। সেই সময়ের আগে, রস বড় মাটির পাত্রে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হত। সেই গুড় থেকে উৎপন্ন হত চিনি, তবে ওই পদ্ধতিটা ছিল আদিম। ওই গুড়কে ‘পাতা’ নামের এক প্রকার শ্যাওলা দিয়ে ঢেকে দেয়া হত। সেই গুড় বা ‘ঝোলাগুড়ে’ যেসব লাল বা বাদামি রং-এর নোংরা থাকত, সেগুলো সরে গিয়ে একসময় চিনি বেরিয়ে আসত। শুদ্ধিকরণের সেই পদ্ধতিটি প্রাচীন হলেও, ওই চিনির স্বাদ নাকি বর্তমানের থেকে অনেক ভালো ছিল। এক সময়, নবীনচন্দ্রের পূর্বপুরুষেরা বাংলার চিনির বাজারের একটা বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন। ১৮৪৬ সালে নবীনের জন্ম হওয়ার সময় থেকেই তাঁর পারিবারিক ব্যবসায়ের রমরমা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। নবীনচন্দ্র তাঁর জন্মের তিন মাসের মধ্যেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। আর্থিক দুরবস্থার কারণে লেখাপড়া না হওয়ায় তিনি ১৮৬৪ সালে, ‘জোড়াসাঁকো’-তে একটা মিষ্টির দোকান খুলেছিলেন। কিন্তু সেই দোকান তেমন চলে নি। এর ঠিক দু-বছর পরে, বাগবাজারের একটি পোড়োবাড়িতে তিনি নতুন একটি মিষ্টির দোকান খুলেছিলেন। সেই সময়, ‘জিলাপি’ আর ‘পাঁচমিশালি মিষ্টি’ বানাতে বানাতে ক্লান্ত নবীনচন্দ্র চাইছিলেন যে, তিনি ছানা দিয়ে এমন একটি রসসিক্ত মিষ্টি বের করবেন, যা সবাইকে চমকে দেবে। একদিন দুপুরে কাজ শেষ করতে করতে তিনি খেয়ালের বশে, ছানার গোল্লাকে চিনির রসে ফেলে ভেজে তুলেছিলেন। এভাবেই খেয়ালের বশেই তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন রসগোল্লার রেসিপি। কিন্তু তাঁর সেই নতুন মিষ্টি জনপ্রিয় হবে কিনা, তা নিয়ে তিনি খুব একটা নিশ্চিন্ত ছিলেন না। তাই তিনি অন্য মিষ্টির সঙ্গে সেটি বিক্রি করতেন না। নবীনচন্দ্রের ‘ম্যানেজমেন্ট’ বা ‘মার্কেট সার্ভে’ সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকলেও তিনি তাঁর সহজাত ব্যবসায়িক বুদ্ধির বলে বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর আবিষ্কৃত সেই নতুন মিষ্টির বাজার প্রতিক্রিয়াটা জানা খুবই জরুরি। তাই তিনি তাঁর আত্মীয়, বন্ধু ও চেনাজানাদের ওই মিষ্টিটি খেতে দিতেন -- তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য। এরপরে একদিন সকালে, নবীনচন্দ্রের বাগবাজারের দোকানের সামনে হাজির হয়েছিল একটি ঘোড়ায় টানা জুড়িগাড়ি। সেই গাড়িতে ছিলেন তৎকালীন কলকাতার ধনী ব্যবসায়ী -- ‘ভগবানদাস বাগলা’। সেদিন ভগবানদাসের এক ছেলের খুবই জল তেষ্টা পেয়েছিল। নবীনচন্দ্র এগিয়ে এসে তাঁকে জল দিয়েছিলেন এবং সঙ্গে দিয়েছিলেন একটি রসগোল্লা। ওই ছেলেটি সেই নতুন ধরনের মিষ্টি দেখে প্রথমে একটু থমকালেও, সেটি খেয়ে একেবারে আহ্লাদিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ছুটে গিয়ে তাঁর বাবাকেও সেই মিষ্টিটি খেয়ে দেখতে বলেছিলেন। রসগোল্লা খেয়ে ভগবানদাসও বাক্যহারা হয়ে গিয়েছিলেন। এরপরে নিজের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের জন্য ভগবানদাস, নবীনের কাছ থেকে কয়েক হাঁড়ি রসগোল্লা কিনে নিয়েছিলেন। এবং কার্যত ওই দিন থেকেই, বাঙালির মিষ্টির রাজ্যে রসগোল্লার সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু হয়েছিল। রসগোল্লা জনপ্রিয় হবার পরে, সেটির একটি ‘শিশু সংস্করণ’ বের হয়েছিল। সেই মিষ্টির নাম ছিল -- ‘রসমুণ্ডী’। বিংশ শতকের গোড়ার দিকের kolkata-য় একটা রসগোল্লার দাম ছিল -- দু-পয়সা। আর ওই একই সময়ের kolkata-য় এক পয়সাতে চারটে ‘রসমুণ্ডী’ পাওয়া যেত। উপরন্তু ক্রেতা ‘ফাউ’ চাইলে দোকানীরা একটা ‘ফাউ’ও দিতেন। ১৯৮৮ সালের ১১ই এপ্রিল তারিখের ‘বর্তমান’ পত্রিকায় প্রকাশিত ওই প্রবন্ধে, ‘গৌতম হোড়’ আরও লিখেছিলেন যে -- “সিমলার নকুড় নন্দীর দোকানও ১৪৪ বছরের পুরানো।” যদিও এটি সন্দেহজনক উক্তি। কেন-না আজ পর্যন্ত কেউই সঠিকভাবে জানেন না যে পুরানো kolkata-র কোনো মিষ্টির দোকান ঠিক কতটা প্রাচীন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ‘নকুড় নন্দী’র শ্বশুরমশাই ছিলেন গিরীশচন্দ্র দে। ‘কড়া পাক সন্দেশ’ তৈরির জন্য, পুরানো kolkata-য় তাঁর অসাধারণ প্রসিদ্ধি ছিল। কলকাতায় ‘শোনপাপড়ি’ চালু করেছিলেন -- ‘নেপালচন্দ্র হালুইকর’। তাঁর আদি দোকানটি ছিল ‘আর্মেনিয়ান স্ট্রিটে’। তবে ‘শোনপাপড়ি’ অবশ্য ‘নেপালচন্দ্র হালুইকরের’ আবিষ্কৃত মিষ্টি নয়। তাঁর অনেক আগে থেকেই, ‘বিহার’ ও ‘উত্তরপ্রদেশে’ ওই মিষ্টিটি প্রচলিত ছিল। স্বামী বিবেকানন্দের অনুজ, মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছিলেন যে, উত্তর ভারতের মিষ্টান্ন, যথা -- ‘অমৃতি’, ‘জিলাপি’, ‘বালুসাই’, ‘রাবড়ি’ ইত্যাদি তাঁর সময়েই অর্থাৎ উনিশ শতকের শেষের দিকে kolkata-য় আমদানি করা হত। মহেন্দ্রনাথ দত্ত প্রদত্ত তত্ত্বে ভুল কিছু নেই, কারণ, কলকাতায় উত্তর ভারতের মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারকদের আগমন ঘটেছিল ১৮৬৪-৬৫ সাল নাগাদ, অর্থাৎ, kolkata-র সঙ্গে উত্তর ভারতের রেলপথে যোগাযোগ স্থাপনের পরে।

হরিদাস মোদকের মিষ্টির দোকান                                          
বিংশ শতাব্দীর সূত্রপাতের কলকাতায়, ‘শ্যামবাজারের’ ‘পাঁচমাথার মোড়ের’ প্রসিদ্ধ সন্দেশ-দইয়ের দোকান ছিল ‘হরিদাস মোদকের’। প্রথম দিকে হরিদাস মোদকের দোকানটি ছিল ‘শ্যামবাজার বাজারের পূর্বদিকে’, একখানা চালা ঘরের মধ্যে, ‘শ্যামবাজার ব্রিজ রোডের’ ওপরে। পরে ওই রাস্তা বিস্তৃতকরণ করে ‘আর. জি. কর রোড’ সৃষ্টির সময়, হরিদাস মোদকের দোকানটি উঠে এসেছিল ‘শ্যামবাজার পাঁচমাথা’র সামনে - ‘আপার সার্কুলার রোডের উপরে (বর্তমানের ‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্ৰ রোড’)। সেই দোকানটি এখনও জীবিত রয়েছে। ‘সন্দেশ’, ‘ছানার জিলাপি’ ও ‘জিভেগজা’র জন্য ওই দোকানটি এখনও বিখ্যাত। 

সমসাময়িক কলকাতার অন্যান্য মিষ্টির দোকান
ওই একই সময়ে, ‘শ্যামবাজারের’ ‘মম্বুলিয়াটোলা’য় ছিল ‘দ্বারিকচন্দ্র ঘোষের’ দোকান। দ্বারিকচন্দ্ররও সুনাম ছিল ‘সন্দেশ’ ও ‘দই’য়ের জন্য। বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকের শেষের দিকে, দ্বারিকের আরেকটি দোকান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল - ‘শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ে’। তার আগে, ওই একই জায়গায় ছিল - ‘বিপিন ময়রার দোকান’। পরে কলকাতার নানা জায়গায় দ্বারিকের দোকানের আরো বিভিন্ন শাখা খোলা হয়েছিল। এমনকি কলকাতার বাইরে, ‘দেওঘরে’ও দ্বারিকচন্দ্রর একখানা দোকান খোলা হয়েছিল। কিন্তু পরে গৃহবিবাদের জেরে, দ্বারিকের দোকানগুলির হয় বিলুপ্তি, আর তা নয় তো অবনতি ঘটেছিল। বর্তমানের শ্যামবাজারের শ্রেষ্ঠ মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারক হল, ‘ফড়িয়াপুকুর স্ট্রীটের’ ‘সেন মহাশয়’-এর দোকান। ওই দোকানের ‘কেশব ভোগ’ ও ‘মালাই চপ’ বিখ্যাত। কলকাতার ‘বহুবাজার’ বা ‘বৌবাজার’ অঞ্চলের ‘নবকৃষ্ণ গুঁইয়ের’ দোকানের এখন বৃদ্ধি ঘটেছে। ওই দোকানের তৈরি ‘ছানার মুড়কি’ তুলনাহীন ও অদ্বিতীয়। এরই পাশে ‘ভীম নাগের’ দোকানের আয়তন ক্রমশঃ হ্রাস পেয়েছে। অথচ একসময় ‘ভীম নাগ’ই ছিল কলকাতার শ্রেষ্ঠ মিষ্টান্ন বিক্রেতা। অতীতে অনেককেই দেখেছিলেন যে, ‘বাংলার বাঘ’ খ্যাত ‘স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়’, বিকালে ‘কলেজ স্ট্রিট’ ও ‘বঙ্কিম চাটুজ্যে স্ট্রিটের’ মোড়ে পুরানো ‘অ্যালবার্ট বিল্ডিং’-এর তলায় অবস্থিত ‘আর ক্যামব্রের বইয়ের দোকানে’ গল্পগুজব করে, বাড়ি ফেরবার পথে তাঁর গাড়ি দাঁড় করাতেন ভীম নাগের দোকানের সামনে, এবং ওই দোকান থেকে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হত আধ সের সন্দেশ, যা তাঁর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাত না। গাড়িতে বসেই মিষ্টান্নবিলাসী স্যার আশুতোষ, সেটা শেষ করতেন। তবে ভীম নাগের দোকান, আকৃতিতে অনেক ছোটো হয়ে গেলেও, ওই দোকানের তৈরি সন্দেশ -- গুণ ও স্বাদের দিক দিয়ে আজও পুরানো কলকাতার ঐতিহ্যকেই বহন করে। বর্তমানে তো কলকাতার অলিতে গলিতে মিষ্টান্নের দোকান। তবে সেই সব দোকানের মধ্যেও পুরানো কলকাতার কয়েকটি দোকান, বিশেষ ধরনের মিষ্টান্নের জন্য বিখ্যাত। যেমন - ‘শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ের’ কাছের ‘যোগমায়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের’ ‘ভাপা সন্দেশ’, ‘শৈল সুইটস’-এর ‘ল্যাংচা’, ‘ফড়িয়াপুকুরের মোড়ে’ ‘অমৃত’-এর ‘দই’, ‘জলযোগ’-এর ‘দই’ ও বড়দিনের সময় তৈরী নানারকমের ‘কেক’ ইত্যাদি, ‘রাধা সিনেমা’র নীচে অবস্থিত ‘কে. সি. ঘোষের’ দোকানের ‘রসমালাই’ ও ‘মালাই চপ’, ‘গোপাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের’ ‘নোনতা’, ‘ঢাকাই পরোটা’, ‘ঢাকাই শোনপাপড়ি’, ‘কড়াপাকের অমৃতি’ ও ‘ক্রিম রোল’, ‘রঙমহল থিয়েটারের’ পাশে অবস্থিত ‘নদীয়া সুইটস’-এর ‘পান্তুয়া’ ও ‘সরপুরিয়া-সরভাজা’, ‘গরাণহাটার মোড়ে’ অবস্থিত ‘সত্যনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের’ সকালবেলার ‘জিলিপি’ ও বিকেলবেলার ‘মালপোয়া’, ‘সুকিয়া স্ট্রীটের’ ‘নন্দলাল ঘোষের’ দোকানের ‘রাবড়ি’, ‘জোড়াসাঁকো’র ‘নেপাল হালুইকরের’ ‘গাজরের হালুয়া’, ‘বিবেকানন্দ রোড’ ও ‘সেন্ট্রাল অ্যাভেন্যু’র মোড়ে অবস্থিত ‘শর্মা’র দোকানের ‘কালাকাঁদ’ ও ‘কাজু বরফি’, ‘কলেজ স্ট্রীটের মোড়ে’ ‘কলেজ রো’-এর ভিতরে অবস্থিত ‘সন্তোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের’ ‘ছানার পায়েস’, ‘শিয়ালদহের’ কাছে অবস্থিত ‘নাটোর সুইটস’-এর ‘রসকদম্ব’, ‘মধুরিমা’র ‘রসকদম্ব’, ‘সত্যনারায়ণ গুপ্তের’ ‘সন্দেশ’, ‘কমলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের’ ‘কমলাভোগ’, ‘নাগের’ ‘ঘিয়েভাজা গজা’, ‘হ্যারিসন রোড’ ও ‘চিৎপুর রোডের’ মোড়ে অবস্থিত ‘ইন্দ্রের দোকানের’ ‘বেদনা বোঁদে’, ‘ধর্মতলা’য় ‘শর্মা’ কিংবা ‘কল্পতরু’র নানারকম মিষ্টান্ন (কম দামি প্যাঁড়া সমেত), ‘জানবাজারের’ ‘সরস্বতী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের’ ‘দই’ ও ‘বেলের মোরব্বা’, ‘তালতলা’র ‘যশোদা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের’ ‘যশোধি’, ‘মল্লিকবাজারের’ ‘লিলী সুইটস’-এর ‘সন্দেশ’ (বিশেষ করে ‘কাঁচাগোল্লা’), ‘বেকবাগানের’ ‘মেঠাই’-এর ‘কড়াপাক সন্দেশ’, ‘তেওয়ারি’র ‘জিলিপি’ ও ‘লাড্ডু’, ‘ভবানীপুরের’ ‘সেন মশাই’-এর ‘রোজক্রীম’ ও ‘দ্বারিক’-এর ‘নিকুতি’, ‘হরির হরিভোগ’ বা ‘কেক সন্দেশ’ ইত্যাদি। তবে পুরানো কলকাতার অনেক ধরনের মিষ্টান্ন এখন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যেমন -- ‘তিলকুটো’, ‘জিভেগজা’, ‘চিত্রকুট’, ‘ক্ষীরের বরফি’, ‘বেলের মোরব্বা’, ‘ছানার গজা’ ইত্যাদি। আগে ওগুলো কলকাতার প্রতিটা মিষ্টান্নের দোকানেই পাওয়া যেত। বর্তমানে কিছু কিছু বিশেষ দোকানে পাওয়া যায়।

তথ্যসূত্র:
১. কলকাতার পুরাতন কাহিনি ও প্রথা -- মহেন্দ্রনাথ দত্ত।

২. কলকাতার কড়চা -- বিনয় ঘোষ।

৩. ৩০০ বছরের কলকাতার পটভূমি ও ইতিকথা -- ড. অতুল সুর।

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ