মাকালী মহাকালী


মাকালী মহাকালী
দেবপ্রসাদ

মা মানে মমতা, মায়া, মা মানে করুণা
অথচ মহাকালীর রূদ্র রূপ দেখি।
কেন দেখি রূদ্র তারে, কেন সে ভীষণা
অতীন্দ্রিয়তার সত্তা ক্রোধাম্বিতা মুখি।
রক্ত মণ্ড মালা গলে, রক্তাক্ত নয়না, 
কেন দেখি রক্তচক্ষু, লাল রক্তমুখি।

দিনরাত ভেদে তার ক্ষমা নাহি চক্ষে।
বহে রক্তধারা তার বুঁদেলা শরীরে।
শব স্তূপ দিয়ে চলে মুণ্ডমালা বক্ষে।
ধুলায় ধুসর দেহ, রুর্ধিরাক্ত ঝরে।
মধ্যে মধ্যে ভস্মভেদি প্রকাশিছে চক্ষে।
পুরা সেই কথা হেথা কহি ধীরে ধীরে।

পুরাকালে রম্ভাসুর নামে এক সুর।
ঘোর তপ করে খুশি করে ব্রহ্মদেবে।
সহস্র বৎসর ধ্যান করিল অসুর।
অমরত্ব চাই তার, কহে ব্রহ্মদেবে।
সমরে হারিয়ে সবে যাবে স্বর্গপুর।
অসুর কুলেতে জন্মে, অমরত্ব নেবে।

ব্রহ্মা কহে তুষ্ট হয়ে, অমরত্ব কেন?
এত বড় বিশ্ব তুমি চাও অন্য বর।
চালাক অসুর কহে, কি কহিব হেন।
পড়ে যদি রক্ত মোর ধরিত্রীর পর।
এক বুঁদ রক্ত হতে, ফের জন্মি যেন।
চতুর অসুর বর, পেলো অতঃপর।

বর পেয়ে দুরাচারী হইল বিকট।
ব্রহ্মা কহে ওরে দুষ্ট, তুই দুরাচারী
যত পাপ করে যাবি করিবি কপট।
তোরে যে বধিবে নারী, রূদ্র রূপ ধরি।
এই বলে ব্রহ্মদেব, হয় অপ্রকট।
হাঃ হাঃ রবে রম্ভাসুর, হাসিল হুঙ্কারি।

প্রখর প্রবল রম্ভা, সমরে অনল।
কালদন্তে প্রতিক্ষণ, করিতেছে চূর।
সহস্র ভুজঙ্গ চলে, নানা করি ছল।
দেব মারে নর মারে, মারিছে প্রচুর।
সমরে পড়িয়া রক্ত, বাড়ে তার বল।
রক্তবীজ রম্ভাসুর, হানে স্বর্গপুর।

কার সাধ্য তারে মারে কার এত শক্তি।
নিপট লম্পট নীতি কুনীতি আকর।
স্বর্গ মর্ত পাতালের, সেই এক শক্তি।
শেষকালে তারা গেল, যেথা বজ্রধর।
দেবরাজ বজ্র নিয়ে, দেখালেন শক্তি।
যত কাটে তত বাড়ে, ক্ষণিকের পর।

দেবতারা ভয়ে গেল, যেথা সৃষ্টিধর।
আকুতি মিনতি করে, আর করে ভক্তি।
একি করিলেন দেব, নাশ চরাচর।
কেমনে দিলেন রম্ভে, এরকম শক্তি।
রম্ভাসুর রক্তবীজ, হইল অমর।
কহে ব্রহ্মা দেবরাজে, প্রকাশে বিরক্তি।

কহেছিনু রম্ভাসুরে, যদি তাপ করো।
মারিবে তোমারে নারী, হলে অত্যাচার।
দেই নাই অমরত্ব, কহিনু আবারো।
যাও শক্তি আরাধনা, করো বার বার।
নাহি পাও একবারে, যত বার পারো।
আদ্যাশক্তি মহামায়া, করিবে উদ্ধার।

দেবতারা সবে মিলে, তপ করে যান।
প্রকট হইল মায়া, তাঁর দশ হাত।
মৃন্ময়ী চিন্ময়ী রূপ, স্নেহময়ী প্রাণ।
কহিলেন সব শুনে, তিনি দিবে সাথ।
পুঞ্জীভূত হলো আলো, শক্তি পেলো জান।
মহাশক্তি মহামায়া, যাঁর চার হাত।

যিনি ব্রহ্ম তিনি অগ্নি, তিনি মহাকালী।
বিচ্ছুরিছে অগ্নি চক্ষু, রক্তিমাক্ত ছটা।
চলিল বধিতে রম্ভা, হাতে খড়্গ খালি।
কাটিতে কাটিতে চলে, পড়ে রক্ত ছটা।
মহাসুর মহারণ, করে মহাবলি।
গগণে গগণে উড়ে, মেঘ ঘনঘটা।

কাটিল রম্ভাসুরের, তেজ মুণ্ডখানি।
রক্ত ছুঁলে ভূমি আরো, রক্তবীজ জাগে।
ক্রোধে কালি আরো কাটে, দুলাইয়া বেণী।
মুক্ত করে কেশরাশি, আরো ওঠে রেগে।
মহাতেজ অগ্নিদেহ, হাতে খড়্গখানি।
যত মারে মহাকালি রম্ভা তত জাগে।

শিরোচ্ছেদ করে কালী, রক্ত গিলে খায়।
সুরাসুর নর যত আছে জীবগণ।
বিন্দু বিন্দু রক্তছটা পড়িছে ধরায়।
অগ্নিতেজা মহাকালি, করিল ভোজন।
রক্তবিন্দু আরো কিছু পদে দলে যায়।
এইভাবে অসুরের হইল মরণ।

তবু তায় তুষ্ট নয়, মহাতেজা কালী।
রক্তপান অগ্নিঅঙ্গ, শান্ত নাহি হয়।
প্রসীদ প্রসন্ন মনা, না হইল কালী।
ক্রোধানল না নিভিলে, আসিবে প্রলয়।
সৃষ্টিস্থিতি লয় হবে, আসিবে বৈশালী
দেখিতে দেখিতে জ্বলে দিক শিখাময়।

ত্রাহি ত্রাহি রব ওঠে, দেব দেবালয়ে।
নরলোক ব্রহ্মলোক, কাঁপিল পাতাল।
দেবদেবী সবে মিলে গেল শিবালয়ে।
বাঁচাও বাঁচাও কহি, শোনাইল হাল।
স্বর্গলোক মর্তলোক কম্পিছে হৃদয়ে।
সৃষ্টিকর্তা কহিলেন রক্ষ মহাকাল।

শুনিয়া কহিল হেসে, ওহে ব্রহ্মদেব।
মহাশক্তি মহাকালী, আছে রূদ্রতেজে।
তাহার সম্মুখে গেলে, পড়িবে ভুদেব।
রহ্মাসুর বধ করে, অগ্নিসম সাজে।
সেই ক্রোধ প্রশমনে, যাবে মহাদেব।
কেন চিন্ত দেবকুল, যাও নিজ কাজে।

বিচিত্র কিরীটে বদ্ধ, করে বিনাইয়া
মহাদেব চলিলেন, সমর প্রান্তরে।
ধরনী চুম্বিত জটা, মস্তকে বাঁধিয়া।
জীবন সার্থক হয়, হেরিলে যাহারে।
চিতাভষ্ম মাখি যায়, ত্রিশুল লইয়া।
করে ধরিলেন শূল, লয়ে নিশাকরে।

তরুণ অরুণ ভাতি জ্বলে ত্রিনয়ন।
ভষ্মমাখা শ্যাম অঙ্গে চারু শোভা করে।
মেঘমালে তড়িতের চমক দর্শন।
দিনকর নিশাকর নক্ষত্র নিকরে।
দেখিব বিচিত্র শোভা, কহে দেবগণ।
মহা মহীপাল গণ রাখিল নজরে।

সমর প্রাঙ্গনে আসি শয়ন নীরবে।
মহাকালী ক্রোধে তারে না দেখিল পথে।
মহাক্রোধি মহাশক্তি তা থৈ তা থৈ রবে।
রক্তবীজ মরিয়াছে, মুণ্ড তার হাতে।
পড়িল তাহার পদ, ছাইমাখা শবে।
চকিতে সম্বতি ফেরে, দেখি তার পথে।

রুধিরাক্ত ওষ্ঠ রাঙা রক্তাক্ত ভীষণা।
জিহ্বা বাহিরিল তার, লজ্জাঘন মুখে।
রূদ্রকালী মহাশক্তি প্রশমিত মনা।
লজ্জায় লাজুক দেবী, দেখিলেন তাকে।
পদতলে শুয়ে আছে, এবা কোন্ জনা।
পতিরে দেখিয়া পথে, জিহ্বা মুক্ত রাখে।

তবে দন্তে চাপি জিহ্বা, হলো আনমনা।
অগ্নিসমা মহাদেবী, হলো মাতৃ রূপা।
চর্তুভূজা মহাকালী, মহা পরিত্রাণা।
মৃত্যহরী সুধা দেবী জননী স্বরূপা।
শঙ্কাশূন্যা বিচক্ষণী, ভয় বিমোচনা।
বিশ্ব যার কর-গড়া, মহাবলি দ্বীপা।



Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ