সাহেব-৩ আমরা গরীব বলে
সাহেব-৩
আমরা গরীব বলেআজ সাহেবের অঙ্ক পরীক্ষা, খুব সকালে, না সকালে না ভোর রাতে উঠে চোখে মুখে জল দিয়ে অঙ্ক করতে বসেছে, মা পিঠে পিঠ দিয়ে বসেছে, দশবারোটা অঙ্ক করে সাহেব মাকে বলল-
- শুয়ে পড়ো না মা, কেন শুধু শুধু জেগে আছো? এই অঙ্ক পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই তো শেষ, তারপর তো নাইনে উঠে যাবো, সাহেবের একটাই শখ স্বপনকুমারের বই পড়া, ডিটেকটিভ বই, গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জীর গল্প গুলো সে খুব ভালোবাসে, এই পরীক্ষার সময় ও বইয়ের ভেতরে বই রেখে পড়তো, মা একদিন দেখে ফেলেছে, তারপর থেকে পড়তে বসলেই মা পাশে বসে থাকে।
- তুই পারবি তো বাবা? পড়ার থেকে গল্পের বই বেশি পড়িস।
- পারবো মা, খুব ভালো পরীক্ষা হয়েছে।
- কি করে বুঝলি? তুইতো প্রতিবারেই বলিস, ভালো হয়েছে, একটু বেশি পড়লে, আরো একটু ভালো করতে পারতিস তুই,।
- এবার পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে মা।
বলেই সাহেব আবার অঙ্কে মন দিলো, সব অঙ্ক আগে হয়ে গেছে, এখন শুধু প্রাকটিস করছে, ততক্ষণে মা উঠে চলে গেছে, খুব সকালবেলা থেকে মা কাজে চলে যায়, রাতের করা ভাত খেয়ে স্কুল যায় সাহেব, স্কুল থেকে ফিরে পাঁচটার সময় আবার খায়, আজ মা আলু ভাতের বদলে আলু ভাজা, আর ডাল করেছে, সাহেবের প্রিয় খাবার, খুব আনন্দ হয়, যখন ডালভাত এক সঙ্গে পায়, সর্ষে তেলের দাম তো কম নয়, প্রতিদিন কোনোরকমে চলার মত তেলে আনে ঘরে, একশো গ্রাম তেল এক সপ্তাহ চালাতে হয়, আর একটা বাড়ি কাজ ধরেছে মা, একুশ টাকা মাসে, তাই সেই বাড়ির নাম একুশটাকার বাড়ি, আর ন টাকা মাসে দেয় যারা, সেটা ন টাকার বাড়ি, এ বাড়ির লোক গুলো বেশ ভালো, গরম গরম রুটি তরকারি দেয় মাকে টিফিনের জন্য, মা সে গুলো খায় না, আঁচলে বেঁধে নিয়ে আসে, বোন খায়, ঠাকুমা খায়, বাড়িতে ঠাকুমাই রান্না করে, মা সময় পায় না, তবু যখন মা তাড়াতাড়ি আসে, তখন রান্না করে, মায়ের হাতের রান্না বেশ ভালো লাগে সাহেবের, ঠাকুমাও ভালোই রাঁধে, তবু মায়ের হাতের রান্না সাহেবের বেশি ভালো লাগে।
- নটা বেজে গেল এবার উঠে পড়, স্নান কর, এতোটা হেঁটে যাবি, যদি দেরি হয়ে যায়, পরীক্ষা দিতে পারবি না বড়কচি,
ঠাকুমা সাহেবকে বড়কচি বলে ডাকে, আর বোনকে ছোটকচি, ঠাকুমার ডাক সাহেবের খুব ভালো লাগে, দাদুর কথা বেশ মনে আছে সাহেবের, সাহেব যখন হলো, সাদা ধবধবে, মাথায় লাল চুল, একেবারে ইংরেজ সাহেব, দাদু শখ করে নাম রাখল সাহেব। দাদু কলকাতায় চালের ব্যবসা করতো, গোবিন্দভোগ চালের, দাদু থাকা কালিন সাহেবদের এই অবস্থা ছিল না, দেশের বাড়ি ছিল অনেক বড়, বাড়িতে দশবারো জন কাজ করতো, চালের কাজ, ঢেঁকিতে চাল কুটতো তারা, সেই চাল দাদু কলকাতার নতুনবাজারে গোডাউনে যেতো, ব্যবসা ভালোই ছিল, দেশের বাড়ি, মেদিনীপুর জেলার গোবিন্দ পুর গ্রামে, কত চাষের জমি ছিল, নারকেল গাছ ঘেরা বড় পুকুর, পনের ষোলোটা গাছ ছিল, আজ আর নেই, সব দেনার দায়ে বিকিয়ে গেছে, কিছুটা গেছে, বাবার বোকামোর জন্য।
সাত সন্তান মারা যাওয়ার পর সাহেবের বাবা, অতি কষ্টে বাঁচানো গেছে, বট গাছের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে, কুকুরের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে, তারপর এই অষ্টম গর্ভের সন্তান সাহেবের বাবা, অতি আদরে লালন পালন করেছে ঠাকুমা, তাই বেশ উৎ-শৃঙ্খল হয়ে উঠেছিল বাবা, তাই অল্প বয়সেই বিবাহ দিয়ে সংসারী করলেও তেমন পরিবর্তন আসেনি সাহেবের বাবার। মদ থেকে শুরু করে নানান নেশায় আকৃষ্ট হয়ে পড়ে, সব ছাড়ানো গেলেও মদ তাকে কিছুতেই ছাড়েনি, এখন রোজগারের বেশিরভাগটাই মদে যায়, কারো খাওয়া হলো কি না হলো নিজেরটাই সব, একটু যেন স্বার্থপর গোচের, তবু সংসারের প্রতি ভালোবাসা ছিল না তা বলা যাবে না। যখন দাদু ডায়মন্ডহারবারের নদীতে তিনতিনটে বড় নৌকার চাল সমেত ঝড়ে তলিয়ে গেল, আর দাদুর সেরিব্রালে প্যালাইসিস হলো, পড়ে গেল ডানদিক, তখনই ভেঙে গেল সাহেবদের সংসার, বহু কষ্ট করেও দাদুকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনা গেল না, ব্যবসার পুঁজি কোথায় রাখাছিল কেউ জানতে পারেনি, মহাজনের টাকা আর দাদুর চিকিৎসায় এক এক করে সব জায়গাজমি বিকিয়ে যেতে লাগল, এই সুযোগে আত্মীয় স্বজনরাও সুবিধা ভোগ করতে লাগল, একেতো সাহেবের বাবা জমিজমার সম্বন্ধে কিছু জানতো না, আর সে ছিল আরামি মানুষ। আসলে ভাঙন শুরু হয়েছিল বিয়ের পর, অকস্মাৎ এক ঝড়ে সাহেবদের গোয়াল ভেঙে সতেরটা গরু মরে গেল, তখন পাড়ার সকলে বলল, সাহেবের মা অপয়া, কিন্তু ঠাকুমা সে বলল- না না সেকি করে হয়, একটা এগার বছরের মেয়ে অপয়া হয় কি ভাবে, সাহেবের মায়ের বিয়ের সময় তার বয়স তখন দশ, এরপর থেকে একটারর একটা অঘটন ঘটতেই থাকে, সাহেবের বাবার ট্রাইফয়েডে একটা কান একেবারে কালা হয়ে গেল। তারপর শুরু হলো সাহেবের বড়দাদুর কুকর্ম, এতোদিন দাদুর রোজগারেই তাদের সংসার চলতো, চাষবাস করতো, দাদুকে সহযোগিতা করতো, দাদুর অবর্তমানে চুরিচারা করে গ্রামের মাতোবর হয়ে উঠলো, জোর করে সাহেবদের বাস্তুছাড়া করল, দাদুর মৃত্যুর পর আর থাকতে পারলো না গ্রামে, চলে এলো কলকাতায়, নতুনবাজারে সেই গোডাউনে জায়গা হলো তাদের, এক বিহারী যে গোডাউন দেখা শোনা করতো, সে দাদুর খবর না পেয়ে, গোডাউনের একটা করে অংশ বিহারী আত্মীয় বন্ধুদের এনে জমা করলো, সাহেবের বাবার কোনো রোজগার নেই, তার ওপর পাঁচজন সংসারে, যা কিছু টাকা সেই বিহারী দিতো, তার বেশ কিছুটা অংশ চলে যেতো তার মদ ও জুয়ায়, কলকাতা এসে সাহেবের বাবা জুয়ার নেশাটি ক্রমাগত বাড়তে শুরু করল, জুটলো বন্ধু বান্ধব, ঠাকুমা ও মা ভাবলো এখান থেকে না গেলে একে থামানো যাবে না, সাহেবের জেঠার মেয়ে কাজলী কে বরানগরের বারুইপাড়ায় বিয়ে দিয়েছিল, তাদের বাড়িতে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানেই চলে যেতে বাধ্য হলো। সাহেবকে তখন ওঙ্কারনাথ স্কুল আশ্রমে ক্লাস টুতে ভর্তি করে, মা এবং ঠাকুমা লোকের বাড়ি বাসন মাজার কাজ নিলো, সংসারতো চালাতে হবে বাবার কোনো কাজ নেই, এদিকে বাড়ি ভাড়া দিতেই হবে, গোডাউনের দরুন কিছু টাকা দিয়েছিল বিহারী, বলেছিলো থেকে যেতে, কিন্তু বাবার ওই পরিনতি কিছুতেই সামলানো যাচ্ছিল না। সংসার তো কোন রকমে চলতে লাগল, কিন্তু প্রতি মাসে চলতো ঝগড়া, ভাড়া দেওয়ার সময়, দুচার মাস যায় আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি, সাহেবের বাবার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যেতো না।
Comments
Post a Comment