সাহেব - ২ তুই যে বললি মারবে না।
সাহেব-২
তুই যে বললি মারবে না
দেবপ্রসাদ জানা
- আমাকে একটা ভালো কেট্স কিনে দিতে হবে,
- এখন পয়সা নেই বাবা, পরের বছর কিনে দেবো।
- না আমার এখনি চাই, কেট্সটা ছিঁড়ে গেছে আর পরা যায় না, সকলে কত ভালো ভালো জুতো পরে আসে স্কুলে, আমি কেন কষ্ট করে এসব পরবো, কেন কিনে দেবে না,
- তোর বাবার কি জমিদারি আছে? লোকের বাড়ি বাসন মেজে তোকে পড়াচ্ছি, না হলে রিক্সা টানতিস্।
অনেক কষ্ট নিয়েই হয়তো মা বলেছিল, তবুও রাগ হলো সাহেবের, তার বন্ধুরা কত ভালো ভালো জুতো পরে, ভালো জামা কাপড় পরে, বছরে একটা স্কুলের জামা একটা প্যান্টের বেশি সাহেব কোনোদিন দেখেনি, পুজো সময় সাহেবের জেঠতুতো দাদার একটা জামা টেলারে কেটে কুটে বানিয়ে দিয়েছে তাকে, সেই পোরে তিন বছর কাটালো সাহেব, বেশ ভালোই লাগে তার জামাটা, প্রতি বছর স্কুলের হাফ্ প্যান্টের সাথে জামাটা পরেছে সাহেব, প্রতিবাদও করেনি, বায়নাও করনি, মা লোকের বাড়ি বাসন মেজে, মাসে নটাকা পায়, বাবা তার যা রোজগার করে, রোজের সংসার চালাতে চলে যায়। ভালোমন্দ যা খায়, সব মায়ের কাজের বাড়ি দেওয়া, হয়তো বাসি খাবার, তবু সাহেবের ভালো লাগে খেতে, এই নিয়ে বোন ঝর্ণার সাথে মারপিটও হয়, সেদিন রাতে মায়ের আনা ডাল আলু পোস্ত ভাত, খেতে বসে বোনের সাথে খুব লড়াই, ডালের বাটিটা টানাটানি করতে গিয়ে পড়ে গেল মাটিতে, বাবা এক মিনিটও অপেক্ষা না করে, পাশে রাখা পিড়িটা তুলে সাহেবের মাথায় মেরে দিলো, মাথা ফেটে রক্তারক্তি, মা নিয়ে দৌড়াল কাশিপুর হাসপাতালে, চারটে সেলাই পড়ল, বাবা মায়ের সে কি ঝগড়া, বাবা হয়তো বোনকে বেশি ভালোবাসে, মা সাহেবকে, যদিও সাহেব আজ পর্যন্ত বুঝতে পারেনি তাকে কে বেশি ভালোবাসে, বাবা না মা, সাহেব স্কুলে ফাস্ট হয়, এই নিয়ে মায়েরখুব গর্ব। বনহুগলি হাইস্কুলে মাসের মাইনে দিতে না পারায়, স্কুলে আর রাখেনি তাকে, বরানগর কুঠিঘাটে ভিক্টোরিয়া হাই স্কুলের সহ প্রধান শিক্ষক গুরুপ্রসাদ বাবু তার রেজাল্ট দেখে ভর্তি নিলো স্কুলে, সম্পূর্ণ বিনা মুল্যে, আজ তিন বছর পড়ছে সাহেব, তাছাড়া স্কুলের শেষে প্রাইভেট টিউশনও, সকালে পান্তাভাত খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে বনহুগলি থেকে বরানগর কুঠিঘাটে স্কুল যায় সাহেব, সে দেখতো কত বন্ধুর বাবা কিংবা মা গাড়ি করে পৌঁছে দেয় তাদের, তবুও কোনো ক্ষোভ ছিল না সাহেবের। কষ্ট করলে কেষ্ট পায় এই কথাটা ঠাকুমা বলতো,
-কেষ্ট মানে?
এই প্রশ্নটা সাহেব ঠাকুমাকে জিগেশ করলে, ঠাকুমা বলল-
বড় হবে অন্যের মতো তুমিও গাড়িবাড়ি করবে। বিশ্বাস করেছিল সেদিন সাহেব। ঠাকুমা যখন মারা গেল, খুব কেঁদেছিল সাহেব, মায়ের মার থেকে উদ্ধার করার ঠাকুমাই ছিল এক মাত্র ঢাল। একবার তাঁতিপাড়ায় "জীবন্ত কবর " যাত্রা হবে বন্ধু রঞ্জিতের সঙ্গে জুটি বেঁধে যাত্রা দেখতে যাবে, বাবাকে বলেছিল সাহেব, বাবা দুটাকা দিয়ে বলেছিল মাকে বলতে না, সাহেব যাত্রা থিয়েটার দেখতে খুব ভালোবাসতো, যাত্রা দেখে রাত দুটোয় ফিরেছিল সাহেব, লুকিয়ে ঠাকুমার কোলে শুয়ে পড়েছিল, সকাল হওয়ার আগেই মা তার অস্ত্র ডালের কাঁটাটা তুলে নিয়েছিল হাতে, সে কি মার, আঙুল কটা ডালের কাঁটার প্রহারে ভেঙে যাওয়ার অবস্থা, ঠাকুমা সামনে এসে দাঁড়লো, দু চার ঘা তার কপালেও জুটেছিল। মারার পর ওই মা-ই লুকিয়ে কেঁদেছিল খুব। সরস্বতী পুজোয় রাস্তার ধারে মায়ে ছেঁড়া কাপড় দিয়ে প্যান্ডল করে, নিজের হাতে গড়া সরস্বতী ঠাকুর পেতে পুজো করবে সাহেব, কিন্তু ফল প্রসাদের টাকা নেই, চাঁদা তুলতে হবে, আসেপাশের বাড়ি থেকে চার আনা আট আনা চাঁদা পেলেও ঠাকুর বাড়ির ঠাকুরদা কিছুতেই চাঁদা দিলো না, ওদের একটা গন্ধরাজ লেবুর গাছে তখন অনেক লেবু, ভোর রাতে সব লেবু প্রায় পেড়ে নিয়ে দক্ষিনেশ্বরে মন্দিরের কাছে চারটে চার আনায় বিক্রি করে ফল ফুল এনে পুজো করার পর যখন সকলে জানলো লেবু গুলি কে পেড়েছিল, মাতো রেগে আগুন,
- চুরি করা শিখেছিস, আজ তোর একদিন কি আমার একদিন, মায়ের সেই হাতিয়ার উঠে এলো হাতে, প্রচণ্ড মারের পরও মা আদর করে ডেকে ভাত মুখে তুলে দিয়েছিল মা, তখন একবারও মনে হয়নি পালিয়ে যাবে সাহেব, আজ কি যে হলো, একটা কথা মায়ের কিছুতেই যেন সহ্য হলো না তার,
-তোর জন্মের পরই আমাদের এই অবস্থা, অপয়া কোথাকার,
অবাক হয়ে গেল সাহেব, তার জন্য তাদের এই ভিখারি অবস্থা? অনেক চেষ্টা করেও ভুলতে পারছিল না সাহেব, একটা জুতোর জন্য মা এমন কথা তাকে বলল?
সার্কাস শেষ চারটে বাজে, আর ভালো লাগছিল না সাহেবের বাড়ির জন্য মন কেমন করতে লাগল, রঞ্জিত বলল কি করবি? চল বাড়ি চল,
- না রে মা খুব মারবে,
- আমাদের বাড়ি চল,
রঞ্জিতের বাড়ি যাতায়াত আমার ভালোই, রঞ্জিত মামার বাড়িতে থাকে, বাবা মারা যাওয়ার পর মাকে নিয়ে মামার বাড়িতে, মামা মাছের ব্যবসা করে সাহেবকেও খুব ভালোবাসে, মাঝে মধ্যে ওদের বাড়িতেই খাওয়াদাওয়া করে স্কুল যায় সাহেব। ভারি মজা করতো মামা, পরিমল মামা, কিন্তু রেগে গেলে চণ্ডাল।
এদিকে স্কুলের ছুটি চারটের আগে টিফিনেই হয়ে গেছে, আগামীকাল স্কুলের একশ চারতম জন্মদিন, ফলে আজ হাফ্ ছুটি সেটা খেয়াল ছিল না সাহেব আর রঞ্জিতের, পরিমামা দুপুরে স্কুলের সকলকে ফিরতে দেখে, উতলা হলো, কোথায় গেল রঞ্জিত, সাহেবের বাড়িতেও যেত রঞ্জিত তাই ওখানে খোঁজ করতে গেল, সাহেবের মা তখন সবে খেয়ে কাজে যাবে রেডি হচ্ছে, খবর শুনে দুজনেই খুঁজতে বের হলো, তখনো জানে না লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের কথা, সাহেবের বোন এসে মাকে জানালো, ফেটে পড়ল দুজনে, স্কুলে খবর নিলো যদি টিউশন পড়ে, না সেখানেও নেই, সকলে চিন্তিত। মামা বাড়িতেই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পুলিশে খবর দেবে, বরানগর থানায়, তখন থানা কুঠিঘাটেই।
রঞ্জিত বলল শোন আমরা এক সাথে যাবো না, তুই আলাদা আমি আলাদা। একটু পরে তুই যাস,
রঞ্জিত ঢুকে গেল বাড়ির গলিতে, জ্যোতিনগরের সব গলি দুদিকে মুখ, রঞ্জিত চলে গেলে সাহেব অন্য মুখ দিয়ে ঢুকলো, রঞ্জিতের বাড়ি গলির মাঝামাঝি, দূর থেকে দেখা যায়, ঢুকতেই মামা দেখতে পেলো, ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সাহেব, রাস্তার ধারে পোষ্টে বাঁধা রঞ্জিত, সাহেবকেও বেঁধে ফেলল, মুখোমুখি, সাহেবের মুখ রঞ্জিতের কানের কাছে, একটা ভাঙা খাটিয়ার পায়া হাতে তুলে নিলো সে,
বল কোথায় ছিলি এতক্ষণ,
রঞ্জিতও উত্তর দিলো না, সাহেবও না।
রঞ্জিত সাহেবের কানে কানে বলল,
- এটা দিয়ে মারলে মরে যাবোরে,
সাহেব বলল - আরে না না মারবে না, অত মোটা দিয়ে কেউ মারে? ভয় দেখাচ্ছে, তুই কিন্তু বলবি না, তোর জন্যই আজ এমন হলো, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের আইডিয়াটা তোরই দেওয়া।
মামা তখনো জিগেশ করে যাচ্ছে কোথায় ছিলি?
শেষে বিরক্ত হয়ে সাপোটে এক ঘা বসিয়ে দিলো রঞ্জিতের পেছনে, রঞ্জিত মারের জ্বালা ভুলে বলে উঠলো- তুই যে বললি মারবে না।
Comments
Post a Comment