বামাক্ষেপা
তারাপীঠ মহাশ্মশান। এক অদ্ভুত ব্রহ্মময় নিস্তব্ধতার সাক্ষী এই মায়াবী স্থান। আজ অমানিশার গাঢ় অন্ধকারে ডুব দিয়েছে এই রহস্যে ঘেরা শ্মশানভূমি। চারিদিকে ঝিঝির ডাক, হালকা বাতাসে শুকনো পাতার খরখর, মাঝে মাঝে রাত পাখির কর্কশ চিৎকার ভেঙে দিচ্ছে শ্মশানের নিস্তব্ধতা, চারিদিকের অদ্ভূতুড়ে পরিবেশে ফিসফাস শব্দে জেগে উঠছে কিছু নিশাচর শক্তি। এদিক ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে আধপোড়া মৃত দেহ, বিশ্রী গন্ধ ছড়াচ্ছে তাঁর থেকে। শৃগালের দল ওই মৃতদেহ টেনে ছিঁড়ে তাঁদের পেট ভরছে, মাঝে মাঝে তারস্বরে চিৎকার করছে তাঁরা। মরার খুলি, ভাঙা কলসি, সাদা থান, পোড়া কাঠ ছড়িয়ে রয়েছে এথায় ওথায়। ভয়ংকর অন্ধকারপুরীর রূপ নিয়েছে এই মধ্য রাতের মহাশ্মশান, যেন এক প্রেতরাজ্য।
চারিদিকে অন্ধকারের মাঝে হালকা লালচে আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে ওই যে ওই শ্বেত শিমুল গাছের কাছে। দুটি চিতার প্রায় নিভে আসা আগুনে কিছুটা লালচে আভা ছড়িয়েছে সেই স্থানে। সেখানে পঞ্চমুণ্ডীর আসনের উপর রক্তাম্বরে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছেন এক পুরুষ মূর্তি, স্বয়ং তারাপীঠ ভৈরব শ্রীবামদেব, তারা পুত্র বামাক্ষ্যাপা। এই জনমানবহীন নিশিরাজ্যে তিনি একান্তে তারা মায়ের সাধনায় লিপ্ত। তাঁর সম্মুখে পড়ে রয়েছে কিছু সিদুঁর রাঙানো মানব করোটি, একটি পানপাত্রে মদিরা, রক্ত জবার মালা, টিম টিম করে জ্বলছে একটি প্রদীপ। যদিও তিনি সম্পূর্ণ একা নন, তার প্রিয় কুকুরগুলি তাঁকে ঘিরেই বসে আছে নিভে আসা চিতার পাশে আর ডেকে উঠছে মাঝে মাঝে, যেন কিছু অশুভের সংকেত।
রাত যত বাড়ছে জেগে উঠছে নিশাচরী শক্তিরা যারা সাধনায় বাঁধা দেওয়ার কোনও ত্রুটি রাখছে না। প্রেত, পিশাচ, ডাকিনী সবাই হয়তো উপস্থিত এই মহাশ্মশানের অন্ধকারময় জগতে। কখনো পৈশাচিক চিৎকারে অথবা ভৌতিক দৃশ্যের আশ্রয় নিয়ে বামদেবের ধ্যান ভঙ্গ করার এক উল্লাসের খেলায় মেতেছে তাঁরা। তবু তারাপুত্র তাঁর আসনে অটল, বাইরের জগৎ এর প্রতি তাঁর কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই। একমনে তারাভাবে লীন হয়ে তারামন্ত্র জপে চলেছেন তিনি। তাঁকে ঘিরে রেখেছে তখন প্রেতচক্র, আধ খাওয়া মৃত দেহ গুলিতেও প্রাণের সঞ্চার হয়েছে, বামদেবকে ঘিরে এক উদ্যম পৈশাচিক নৃত্যে মেতে উঠেছে পচাগলা নগ্ন শবদেহের দল। কুকুরগুলিও নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছে। এ হয়তো স্বয়ং ব্রহ্মময়ীর পরীক্ষা, যার জন্যে একের পর এক কঠিন মুহূর্তের সম্মুখীন হচ্ছিলেন তারা মায়ের কোলের ছেলে। হঠাৎ মৃদু পায়ের শব্দে কিছুটা সজাগ হলেন বামদেব, কেউ শুকনো পাতা মারিয়ে এলে যেমন হয় ঠিক তেমন। "বামা ? বাড়ি চল বাবা, কী এই শ্মশানে ঘাটে বসে আছিস" - ভেসে এল এক চেনা নারী কণ্ঠ। হ্যাঁ এ তো তাঁর গর্ভধারিণী মায়ের গলা, কত দিন দেখেন নি তাঁর মা কে তিনি। আবেগে চোখ খুলতে যাবেন এমন সময় মনে হল কোথাও একটা অশুভ ইঙ্গিত, তাঁর মা কিকরে আসবেন এখানে এত রাতে এই তারাপীঠ শ্মশানে ! তিনি বুঝলেন এই সবই তাঁকে পথচ্যুত করার পরিকল্পনা। নিজেকে সামলাতে সক্ষম হলেন তিনি, অনুভব করলেন কোথায় তাঁর মা ? এ এক অশরীরি সৃষ্ট মায়াজাল। নিমেষে আবার সব আগের মতোই শান্ত, নিস্তব্ধ হল। তবে এখানেই শেষ নয়। কিছুক্ষন পরে বামা ঠাকুরের কানে ভেসে এল এক মৃদু নুপুরের ধ্বনি যা ক্রমেই স্পষ্টতর হতে লাগল, কেউ আসছে তাঁর দিকে, কোনও নারী। তবে কি স্বয়ং জগজ্জননী এলেন ?
ধ্যানমগ্ন বামদেব অনুভব করলেন কোনও নারী তাঁকে স্পর্শের দ্বারা নিজের মোহিনী মায়ায় আবদ্ধ করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এটাও মায়া, বুঝতে বাকি রইল না তারাপুত্রের, তারা নামে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন বামাক্ষ্যাপা।
সাথে সাথেই অদৃশ্য হল সেই অশুভ শক্তি। কোন শক্তির ক্ষমতা নেই আজ তাঁকে লক্ষচ্যুত করার। মাঝে মধ্যেই তাঁর "জয় তারা" ধ্বনি তে কেঁপে উঠছে মহাশ্মশান। অশুভের সাধ্য কী স্বয়ং ভৈরবের পথে বাঁধ সাধে !
সাধনার শেষ সময় প্রায় আগত। চিতার আগুন নিভেই গেছে প্রায় তবে রয়ে গেছে চারিদিকে দম বন্ধ করা পোড়া গন্ধ। চিতার নিভু নিভু আগুনের শেষ ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠছে, আরও রহস্যময় করে তুলছে শ্মশানভূমিকে। এক মনে রুদ্রাক্ষের মালা জপে চলেছেন এবং অস্থির হয়ে দেবীকে আবাহন করে চলেছেন বামদেব। কিন্তু কোথায় দেবী ? এত একাগ্র চিত্ত সাধনার পরেও যে তাঁর দেখা নেই। তবে কী ব্রহ্মময়ী দেখা দেবেন না তার প্রিয় পুত্র কে !
আকুল ভাবে তাঁর তারা মাকে ডেকে চলেছেন তারা মায়ের স্নেহধর, তবুও জগজ্জননীর দেখা নেই। অধৈর্য হতে লাগলেন তারাপীঠ ভৈরব, রাগ হতে লাগল তাঁর, নিজের তারা মায়ের উপরে। মন্ত্র জপের মধ্যে মনে মনে বলে উঠলেন "দেখা দিবি না তুই আমায় তাই তো"। এইভাবে শেষ মন্ত্রোচ্চারণের পরও যখন দেবীর আগমন ঘটল না, রেগে গেলেন বামদেব তাঁর মায়ের উপর। রাগে অভিমানে সাধনা ভঙ্গ করে বাচ্চা শিশুর মতো কেঁদে উঠলেন তিনি "দেখা দে মা, কি ভুল করছি আমি ? দেখা দে"। অস্থির ক্ষ্যাপা শিশুর মতো কাঁদতে কাঁদতে তার তারা মা কে ডেকে ডেকে লুটিয়ে পড়লেন শ্মশানভুমিতে, চারিদিক এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় নিমজ্জিত হল। মনে মনে ভেবেই নিলেন হয়তো তিনি ব্যর্থ।
কিন্তু দেবীর লীলা বোঝা দায়। শ্মশানের নিস্তব্ধতা কে চুরমার করে ভেসে এল এক দৈবিক নারী কণ্ঠ "বামা, ওঠ বামা, চোখ খোল দেখ আমি এসেছি"।
অশ্রু ভরা নয়নে মাথা তুলে দেখলেন বামদেব। একি দেখছেন তিনি ! কোথায় সেই শ্মশানের অন্ধকার ? কোথায় সেই মানুষ দহনের শ্বাসরোধ করা গন্ধ ! সমস্ত শ্মশান ভরে গেছে এক অগ্নিময় আলোক তরঙ্গে, মিষ্টি পদ্মের গন্ধে বিভোর চারিদিক। তার সামনে লেলিহান শিখায় জ্বলছে এক বিশাল চিতা, সেই চিতামধ্য হতে উদ্ভব হল এক অপরূপ নারী মূর্তি। নীল গগনের মতো উজ্জ্বল নীল গাত্র বর্ণ, মাথায় মাথায় পিঙ্গল জটা যাতে শোভা পাচ্ছে অর্ধচন্দ্র, সর্পালংকারে সুসজ্জিতা, ব্যাঘ্রচর্মাবৃত তাঁর কটি দেশ, নরকরোটির মালা ঝুলছে তাঁর গলায়, অপরূপা দেবী ত্রিনয়না করালবদনা, নীল পদ্ম ধারিনী হাস্যযুক্তা।
দেবী স্মিত হেসে বললেন "পাগল ছেলে আমার, তুই ডাকবি আর আমি আসব না ? তা কী হয় রে ? এসেছি আমি বামা, তোর সাধনায় আমি তুষ্ট, আমার সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ তুই বামা, তোর ভক্তি আর সাধনার কাছে আমার সকল পরীক্ষা হার মেনেছে বামা, আজ তোর মাতৃপ্রেম ব্রহ্ম আর ব্রহ্মাণ্ড কে এক করেছে, আজ তোর মা ধন্য তোর প্রেম ভক্তি পেয়ে"।
বামা ঠাকুর আহ্লাদিত হলেন "তুই এসেছিস মা ! আমি ধন্য, অপার করুণা তোর, এ তোর কী অপরূপ রূপের বাহার, আমার চক্ষু স্বার্থক রে মা"।
পরম স্নেহময়ী তারিনী তার স্নেহমাখা আশীর্বাদের হাত রাখলেন তাঁর প্রিয় পুত্রের মাথায়।
ত্রিভুবনে ধ্বনিত হতে লাগল ---
ॐ প্রত্যালীঢ় পদাং ঘোরাং মুন্ড মালা বিভূষিতাম্।
খর্ব্বাং লম্বোদরী মীমাংসা ব্যাঘ্র চর্ম্মবৃতাং কটৌ॥
নব যৌবন সম্পন্নাং পঞ্চমুদ্রা বিভূষিতাম্।
চতুর্ভূজাং লোল জিহ্বাং মহাভীমাং বরপ্রদাম্॥
খড়্গ কর্ত্তৃসমাযুক্তা সব্যেতর ভুজদ্বয়াম্।
কপালোৎপল সংযুক্ত সব্যপাণি যুগান্বিতাং॥
পিঙ্গোগ্রৈক জটাং ধ্যায়েন্মৌলীব ক্ষোভ্য ভূষিতাম্।
বালর্ক মন্ডলাকার লোচন ত্রয়যুতে ভূষিতাম্॥
জ্বলচ্চিতা মধ্যগতাং ঘোরদংষ্ট্রাং করালিনীম্।
সাবেশস্মের বদনাং স্ত্র্যলঙ্কার ভূষিতাম্॥
বিশ্ব ব্যাপক তোয়ান্তঃ শ্বেত পদ্মো পরিস্থিতাম্।
আক্ষোভ্য দেবী মূর্দ্ধন্যস্ত্রী মূর্ত্তি নাগরূপ ধৃক্॥
তারা সিদ্ধ হলেন তারাপুত্র।
ॐ নবরূপী আশুতোষং সৌম্য আনন্দ চারুহং সং
সিন্দুর চন্দন ভাল্যং রুদ্রাক্ষ মাল্যং চর্চিত গলং
ভষ্ম ভূষিত কায়ব্যূহ আসবানন্দ নয়ন পরব্রহ্ম সরূপং
বালভাব প্রকাশং বিগলিতং কেশ-ভার ক্ষীণবাসনং
তারা চরণং তারানাদং নয়ন হিনং তারানাদ পরহিনং
ভক্তি হিনং মরমুক্ষাং মোক্ষকারীং শ্মশানচারীং বিহারীং
ভজে বরং ত্বং বামদেবায় মহেশ্বরায় নমঃ॥
.
জয় মা তারা 🌺
Comments
Post a Comment