অবতার
দশাবতারের অন্ত্যলীলায় মহাদেবের ভূমিকা :—
স্বামী গুণালয়ানন্দ
〰️〰️〰️〰️〰️〰️〰️
দেবতা ও মানবের কার্য সাধন করতে ভগবান শ্রীবিষ্ণু বারবার অবতীর্ণ হন। তারপর কার্য সমাধা হয়ে গেলে, প্রায়ই তিনি এমন সব কাজ করেন, যাতে দেবতা বা প্রকৃতির বিঘ্ন ঘটে। অথবা কখনো কখনো কার্য সমাধান করে তিনি কিছুতেই বৈকুণ্ঠে ফিরে যেতে চান না। কথায় বলে — ‘পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে’। তখন প্রতিবার শিব এসে যুদ্ধ করে তাঁর দেহটা বিনাশ করেন এবং তিনি হাসতে হাসতে বৈকুণ্ঠে চলে যান। এমনটাই হয় প্রায় প্রতিবার। ঈশ্বর বালক স্বভাব, হরিহর অভেদাত্মা, এই সৃষ্টি তাঁর খেলা, শিশুর মতই হয়তো বা তাঁদেরও একটু ইচ্ছা হয় যে—খানিক দুজনে যুদ্ধ খেলা হোক, তাই হয়তো বারবার এমনটা ঘটে। এতে অবতার লীলায় নাটকের শেষ অংকটাতে বেশ একটা মারমার কাটকাট ব্যাপার ঘটে। যেমন ছোট ভাই খেলতে খেলতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে, ঘরে ফেরার নাম নেই, বড় ভাই এসে হিড়হিড়িয়ে ঘরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এখানে দুই ভাইয়েরই অবদান রয়ে যায়। অভেদাত্মা বলে কথা, একের মহিমায় অপরে মহিমান্বিত। আশা করি কেউ ভুল বুঝবেন না। কৃষ্ণ-যজুর্বেদের স্কন্দোপনিষদে উক্ত হয়েছে—
শিবায় বিষ্ণুরূপায় শিবরূপায় বিষ্ণবে।
শিবস্য হৃদয়ং বিষ্ণুঃ বিষ্ণোশ্চ হৃদয়ং শিবঃ॥৮॥
যথা শিবময়ো বিষ্ণুরেবং বিষ্ণুময়ঃ শিবঃ।
যথান্তরং ন পশ্যামি তথা মে স্বস্তিরায়ুষি॥৯॥
যথান্তরং ন ভেদাঃ স্যুঃ শিবকেশবয়োস্তথা*।
দেহো দেবালয়ঃ প্রোক্তঃ স জীবঃ কেবলঃ শিবঃ॥১০॥
(*পাঠান্তর — শিবরাঘবয়োস্তথা)
—অর্থাৎ, শিবরূপী বিষ্ণু ও বিষ্ণুরূপী শিব, শিবের হৃদয় বিষ্ণু ও বিষ্ণুর হৃদয় শিব। যথা শিব তথা বিষ্ণু ও যথা বিষ্ণু তথা শিব, যাবৎ হরিহরে অভেদ দর্শন করি তাবৎ আমার জীবন দীর্ঘ ও মঙ্গলময় হোক। যেমন জীব ও শিবে ভেদ নেই, দেহ ও দেবালয়ে ভেদ নেই, তেমন হরি ও হরেও কোনো ভেদ নেই।
১) মৎস্যাবতারের অন্ত্যলীলা — মৎস্যলীলার প্রয়োজন সমাপ্ত হওয়ার পরে বিষ্ণু সমুদ্রেই থেকে গেলেন। এদিকে এক শিবভক্ত অসুর এসে ব্রহ্মার থেকে বেদ অপহরণ করে সমুদ্রে এসে লুকালো। তখন ব্রহ্মার অনুরোধে মীনরূপী বিষ্ণু সেই অসুরকে বিনাশ করলেন। কিন্তু, অসুরের রক্তের প্রভাবে তিনি আত্মবিস্তৃত হয়ে নিজের দেহকে ক্রমাগত বৃদ্ধি করতে থাকলেন। এর ফলে সমুদ্র ক্রমাগত জীবহীন হতে থাকলে ব্রহ্মা শিবের কাছে এই বিপদের কথা নিবেদন করলেন। তখন শিব জেলের রূপ ধারণ করে বিশাল এক জাল ফেলে বিষ্ণুরূপী সেই মৎস্যকে ধরে বধ করে মৎস্যাবতারের দুই চোখ খুলে নিয়ে আংটিতে ধারণ করলেন।
২) কূর্মাবতারের অন্ত্যলীলা — সমুদ্রমন্থনে বিষ্ণু কূর্মের রূপ ধারণ করে মন্দার পর্বতকে বহন করেছিলেন। তারপর সেই কূর্মরূপী বিষ্ণু সাত সমুদ্রের জল খেতে আরম্ভ করলে সমুদ্র ক্রমশঃ জলহীন হতে শুরু করল। তখন শিব এসে কূর্মকে বধ করলেন এবং তাঁর খোল দিয়ে বর্ম তৈরী করে ধারণ করলেন।
৩) বরাহাবতারের অন্ত্যলীলা — বরাহাবতারে বিষ্ণু হিরণ্যাক্ষ দৈত্যকে বধ করার পরে আর বৈকুণ্ঠে ফিরে যাওয়ার নাম করেন না। পৃথিবীও শূকরীর রূপ ধারণ করে বিষ্ণুর কাছে এলেন, দুজনের অনেক ছানাপোনা হল। এদিকে বৈকুণ্ঠে খালি দেখে দেবতারা শিবের কাছে প্রার্থনা করলেন বিষ্ণুকে ফিরিয়ে আনতে। বরাহাবতারের সঙ্গে শিবের খুব যুদ্ধ হলো। শিব বরাহকে মেরে তাঁর দুটো দাঁত খুলে গলায় লকেট করে পড়লেন।
৪) নৃসিংহাবতারের অন্ত্যলীলা — হিরণ্যকশিপুকে নিধন করে নৃসিংহের ক্রোধ কিছুতেই শান্ত হচ্ছিল না। এদিকে পৃথিবী ধ্বংসের মুখে। তখন শিব শরভমূর্তি ধারণ করে নৃসিংহের সঙ্গে খুব যুদ্ধ করলেন। শিব নৃসিংহকে বধ করে তাঁর চামড়াকে উত্তরীয় বানিয়ে ধারণ করলেন।
৫) বামনাবতারের অন্ত্যলীলা — ত্রিবিক্রমরূপ ধারণ করে বামন অবতার বলিকে পাতালে পাঠালেন এবং ইন্দ্রকে তাঁর রাজত্ব ফিরিয়ে দিলেন। এরপর বামনের মনে অহংকার হল, তখন তিনি তাঁর দেহকে ক্রমাগত বৃদ্ধি করতে থাকলেন, চন্দ্র সূর্য ঢাকা পড়লো সেই বিশাল দেহের আড়ালে। এদিকে বিশ্বসংসার ধ্বংস হচ্ছে দেখে শিব যুদ্ধ করে বামনকে বিনাশ করলেন এবং বামন অবতারের হাড়গোড় থেকে অলংকার তৈরী করে সর্বাঙ্গে ধারণ করলেন। শিবের এই মূর্তির নাম কঙ্কালমূর্তি।
৬) পরশুরামাবতারের অন্ত্যলীলা — পরশুরাম অমর। রামের সঙ্গে হরধনুভঙ্গ নিয়ে বিবাদে রামচন্দ্র পরশুরামের অপর একটা শিবধনুতে তীর যোজনা করে তাঁর তপস্যার্জিত সমস্ত পূণ্য বিনষ্ট করেছিলেন। ঘুরেফিরে সেই শিবেরই ধনুতেই তিনি পূণ্যহীন হয়ে বিচরণ করতে লাগলেন, এখানে শিব প্রত্যক্ষতঃ না হলেও তাঁর উগ্ৰতপস্যা ধ্বংসের নিমিত্তকারণ হলেন।
৭) রামাবতারের অন্ত্যলীলা — দুর্বাসা মুনি শিবের অবতার। যখন বিধাতাপুরুষের সঙ্গে রামের অন্তরঙ্গ আলোচনা চলছিল, তখন শর্ত ছিল তাঁদের আলোচনার সময়ে যে ব্যক্তি আলোচনা-কক্ষে উপস্থিত হবেন, রাম তাঁকে পরিত্যাগ করবেন। লক্ষ্মণ প্রহরায় ছিলেন, এমন সময় দুর্বাসা মুনি উপস্থিত হয়ে রামের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। দুর্বাসার অভিশাপের ভয়ে ভীত হয়ে লক্ষ্মণ আলোচনা-কক্ষে প্রবেশ করলেন। শর্তমতো লক্ষ্মণকে হারানোর দুঃখে রামচন্দ্র সরযু নদীতে প্রবেশ করে বৈকুণ্ঠে ফিরলেন। অতএব শিবের অবতার দুর্বাসা মুনি রামের অন্ত্যলীলার কারণ।
৮) কৃষ্ণাবতারের অন্ত্যলীলা — শ্রীকৃষ্ণের অন্তলীলার কারণও শিবাবতার দুর্বাসা মুনি। কারণ দুর্বাসা, নারদ ও কন্ব মুনির অভিশাপেই কৃষ্ণের পুত্র শাম্ব যদুকুল বিনাশকারী মুষল প্রসব করেছিলেন — ‘মুষলং কুলনাশনম্’। সেই লোহার মুষলকে ঘষে ঘষে চূর্ণ করে একটা অংশ রয়ে গেল যেটা আর কিছুতেই চূর্ণ হলো না। সেই সমস্ত লোহা সমুদ্রে ফেলা হলে লৌহচূর্ণ থেকে নলখাগড়া বনের উৎপত্তি হলো এবং অবশিষ্ট লোহার টুকরোটা একটা মাছে খেল। তারপর সেই মাছ জালে ধরা পড়ল, মাছের পেট কেটে বেরনো লোহার টুকরো দিয়ে জরা নামের ব্যাধ তীর তৈরী করে, সেই তীর দিয়ে কৃষ্ণকে বধ করল। বাকি নলখাগড়ায় যদুকুল ধ্বংস হল। এখানেও কৃষ্ণাবতারের অবসান সেই শিবাবতার দুর্বাসার অভিশাপে।
৯) বুদ্ধাবতারের অন্ত্যলীলা — চুন্দের দেওয়া শূকর মাংস খেয়ে গৌতম বুদ্ধ দেহত্যাগ করেছিলেন। সেই চুন্দ বা সেই শূকর শিবের অবতার ছিল কিনা তা শাস্ত্রে লেখা নেই, কিন্তু অন্য একটা অদ্ভুত সমাপতন আছে। বুদ্ধের মতবাদ সারা ভারতবর্ষে ব্যপ্ত হয়ে গেছিল, শিবাবতার শঙ্করাচার্য সেই বৌদ্ধ মতবাদ খণ্ডন করে বৌদ্ধদের ভারত থেকে বিতাড়িত করেন। এও অন্যপ্রকারে শিবহস্তে বুদ্ধনিধন।
গৌতম বুদ্ধের আগেও বৌদ্ধ মত প্রচলিত ছিল। গৌতমের আগে আরো অনেক বুদ্ধ হয়েছেন। মহাভারতের আদিপর্বে অদিতির কর্ণকুণ্ডল প্রসঙ্গে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী উতঙ্কের কথা পাই। তখন থেকেই বৌদ্ধমত নাস্তিক দর্শন বলে আখ্যাত হয়েছে। বৃহস্পতির কুপরামর্শে ত্রিপুরাসুরের অন্তঃপুর-বাসিনীরা বেদমত পরিত্যাগ করে নাস্তিকমত গ্রহণ করে, ত্রিপুরাসুর পূণ্যহীন হয়ে যায়। তখন শিবহস্তে ত্রিপুরাসুরের পতন হয়। শূন্যে ভাসমান ত্রিপুরের মধ্যে বৌদ্ধ শূন্যবাদদের একটা ইঙ্গিত এবং ত্রিপুরীর মধ্যে ত্রিরত্নের বৌদ্ধভাব প্রচ্ছন্নভাবে থাকলেও থাকতে পারে।
১০) কল্ক্যবতারের অন্ত্যলীলা —
কল্কি অবতার নিয়ে কল্পনা না করে বরং বাংলার দুই অবতারের কথা বলব, যাদের অন্ত্যলীলার সঙ্গে শিবের একটা বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। প্রথমতঃ শ্রীচৈতন্য, দ্বিতীয়তঃ শ্রীরামকৃষ্ণ।
চৈতন্যদেবকে পাঠানো অদ্বৈত আচার্যের সাংকেতিক ভাষায় লেখা চিঠি, যেখানে বলা হয়েছে— ‘আউলরে কহিও কহিয়াছে আউল...’ ইত্যাদি, যে চিঠি পড়ে মহাপ্রভুর মন লীলাসংবরণের জন্য প্রস্তুত হয়। অন্যদিকে গিরিশ ঘোষের পাপ গ্রহণ করে রামকৃষ্ণদেবের গলায় ক্যান্সার হয়। ভেবে দেখলে অবাক লাগে, অদ্বৈত প্রভু শিবের অংশ এবং গিরিশ ঘোষ ভৈরব, মানে প্রকারান্তরে সেই শিবেরই অংশ, যাঁরা (অদ্বৈত ও গিরিশচন্দ্র) এই দুই অবতারের লীলা সংবরণের নিমিত্তকারণ হয়েছিলেন।
অধিক আর কি বলবো ! “যথা শিবস্তথা বিষ্ণুর্যথা বিষ্ণুস্তথা শিবঃ। অন্তরং শিববিষ্ণোশ্চোভোয়োঽপি ন বিদ্যতে॥” —স্কন্দপুরাণ ২৩/৪১
Comments
Post a Comment