কালিঘাট
মহাতীর্থ কালীঘাট
(নৃপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস ।ইন্দ্রনগর,বহরমপুর।)
আধুনিক কলিকাতা আজ পরিপূর্ণ জনবহুল মহানগরী ।মহানগরীর বুকে অবস্থিত মহাতীর্থ কালীঘাট সতীপীঠ ।সত্যযুগে স্থানটি ছিল পুণ্য সলিলা পতিতপাবনী মা গঙ্গার তীরবর্তীর গভীর অরণ্যভূমি ।তারই মাঝে লুক্কায়িত এক মহাতীর্থক্ষেত্র ।এখানে বসে বহুকাল ধরে তপস্যা করে প্রজাপতি ব্রহ্মা তাঁর বাঞ্ছিত ফল লাভ করেছিলেন ।দেবী ভাগবত ,স্কন্দ পুরাণ ও লিঙ্গ পুরাণের বর্ণনায় বর্ণিত লোমহর্ষক ইতিহাস আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ।
পুরাকালে আদ্যাশক্তি মহামায়া ত্রিকালেশ্বর মহাদেবকে পতিরূপে পেতে চান ।তাই তিনি সাকাররূপ নিতে যাচ্ছেন ।ব্রহ্মার পুত্র প্রজাপতি দক্ষ তাঁকে কন্যারূপে পেতে সাধনায় বসেন ।সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে আদ্যাশক্তি মহামায়া জানান ,তিনি তাঁকে কন্যারূপে পাবেন ।তবে ,দেবাদীদেব মহাদেব তার পতি হবেন ।সুনির্দিষ্ট সময়ে আদিমাতা শতরূপা ও আদিপিতা মনুর কন্যা ,দক্ষরাজের পত্নী প্রশুতি ,দেবীশক্তিকে জন্ম দেন । নাম রাখেন সতী ।দক্ষরাজের কন্যা বলে তাঁকে দ্রাক্ষায়নীও বলতেন ।যৌবনবতী সতী বিবাহযোগ্য হলে দক্ষরাজ তাঁর প্রতিশ্রুতির কথা বিস্মৃত হন ।দেবাদীদেব মহাদেবকে সহ্য করতে না পারায় তিনি বিবাহে আপত্তি জানান ।পিতার কথা অগ্রাহ্য করে সতী মহাদেবকে বিবাহ করে কৈলাসে যান ।কিছুকাল পর সতীদেবীর কানে আসে ,পিতা দক্ষ যজ্ঞ করছেন ।অন্যান্য মেয়ে-জামাই ,প্রজাবৃন্দ ও দেব-দেবীদের আমন্ত্রণ জানালেও বাদ রাখেন সতী ও দেবাদীদেব মহাদেবকে ।স্বামীর নিষেধ সত্ত্বেও সতী পিতার যজ্ঞস্থলে গিয়ে দেখেন সবাই রয়েছেন ।বাদ শুধু মহাদেব ।যজ্ঞের আহুতি থেকেও তাঁকে বঞ্চিত রেখেছেন ।কারণ জিজ্ঞাসা করলে ,দক্ষরাজ ক্রুদ্ধ হয়ে সতীকে ভর্তষণা করেন ও শিবকে গালমন্দ করেন ।সবার সামনে স্বামী নিন্দা সহ্য করতে না’পেরে ধ্যানস্ত হয়ে নিজ তেজাগ্নিতে সতীদেবী আত্মাহুতি দেন ।সংবাদ পেয়ে দেবাদীদেব মহাদেব যজ্ঞস্থলে ছুটে এসে যজ্ঞ লণ্ডভণ্ড করে প্রাণহীন সতীদেবীর দেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয় তাণ্ডব শুরু করেন ।তাঁর তাণ্ডব নৃত্যে সৃষ্টি স্থিতি লয়ের আশঙ্কায় সমস্ত দেব-দেবী শ্রীহরি নারায়ণের শরণাপন্ন হলে ,শ্রীহরি নারায়ণ তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে ,সতীদেবীর নশ্বরদেহ খণ্ডবিখণ্ড করতে থাকেন ।তাঁর খণ্ডবিখণ্ডিত দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত হয়ে পৃথিবীর যেসব স্থানে পতিত হয়েছিল ;স্থানগুলি এক একটি সতীপীঠে পরিণত হয় ।এই কালীঘাটে সতীদেবীর ডান চরণের চারটি আঙুল পতিত হওয়ায় এই স্থান হিন্দুদের মহাতীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয় ।১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে জবচার্নক কলিকাতা ,সুতানুটি ও গোবিন্দপুর গ্রামতিনটি নিয়ে যে শহর কলিকাতার পত্তনি দিয়েছিলেন ,সেই গোবিন্দপুর গ্রামের দক্ষিণে প্রবাহিত গঙ্গার তীরবর্তী স্থানে এই মহাতীর্থ কালীঘাট সতীপীঠ ।নিগমতন্ত্রে কালীক্ষেত্রের আয়তন রয়েছে দুই যোজন ব্যাপী ।আকৃতি ধনুকের মত ।দক্ষিণে দক্ষিণেশ্বর হতে বগুলাপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ।অন্তর্বর্তী ত্রিকোণস্থানে ত্রিগুনাত্মিক ব্রহ্মা ,বিষ্ণু ও মহেশ্বরের মধ্যবর্তী স্থানে বিরাজমান ।আদ্যাশক্তির মূল বিগ্রহ দেবীকালিকা ।শ্রীশ্রী চণ্ডীদেবীর মাহাত্ম্য থেকে কালী নামের উৎপত্তি ।এখানকার কালীতীর্থের কালীপীঠ তথা কালীভট্ট বা কালীঘাটের মাহাত্ম্য অপরিসীম ।নীচ দিয়ে প্রবাহিতা যেমন ব্রহ্মবারি স্বরুপা গঙ্গা ,তেমনি বিরাজমান সদাশিব নকুলেশ্বর মহাদেব ।পীঠের অধিশ্বরী কালীমাতাকে ঘিরে ব্রহ্মা ,বিষ্ণু ও মহেশ্বরের সাথে ভৈরবী ,বগুলামুখী ,বিদ্যা ,মাতঙ্গী ,কমলা ,ব্রাহ্মী ,মহেশ্বরী ও সনাতনী চণ্ডী এই অষ্ট সখী এখানে বিরাজমান ।
তখন সত্যযুগ ।দেব-অসুরে তুমুল যুদ্ধ চলছিল ।পদ্মযোনি ব্রহ্মা তখন মা গঙ্গার তীরবর্তী স্থানে দীর্ঘকাল সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন ।সিদ্ধিলাভের স্মৃতি স্বরূপ তিনি একস্থানে একটি শিলাবেদি নির্মাণ করে যান ।সেই শিলাবেদিটিই হয় ব্রহ্মবেদি ।তারপর বহুকাল কেটে যায় ।দেবীকালিকা তখন দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি পর্বতে একটি শিলাস্তম্ভে অবস্থান করছিলেন ।সেই শিলাস্তম্ভে বসে মাতৃসেবক ব্রহ্মানন্দ গিরি বহুকাল ধরে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে না পেরে আত্মাহুতি দিতে অনশনে বসেন । অনশনের কুড়িদিনের দিন কালিকাদেবী দর্শন দেন ।কিন্তু ব্রহ্মানন্দ গিরি মায়ের ভয়ংকর রুপ দর্শনে ভীত সন্ত্রস্ত হলে ,দেবীমা তাঁকে দশ বছরের কিশোরীবেশে দর্শন দিয়ে দুটি বর চাইতে বলেন ।ব্রহ্মানন্দ গিরি ভক্তিভরে প্রণাম করে করুণাময়ী মায়ের কাছে বর দুটি প্রার্থণা করেন ,তিনি যখনি চাইবেন ,মা যেন তখনি দশ বছরের কুমারীরুপেই তাঁকে শিলাস্তম্ভে দর্শন দেন ।আর দ্বিতীয় বরে প্রার্থণা করেন ,তাঁর অমতে মা আর অন্য কোথাও না যান ।তথাস্তু বলে মা অন্তর্ধান করেন ।অপর দিকে মায়ের আরও এক সেবক আত্মারাম ব্রহ্মচারী নানাস্থান ঘুরে শেষে এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে কালীক্ষেত্রে আসেন ।ব্রহ্মার রেখে যাওয়া ব্রহ্মবেদির উপরে তপস্যায় বসেন ।দীর্ঘদিন তপস্যার পর একদিন শেষরাতে দশ বছরের কুমারীবেশে মা কালিকার দর্শন পান ।মা জানান ,বরপুত্র ব্রহ্মানন্দ গিরির ইচ্ছায় দীর্ঘদিন দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি পর্বতের এক শিলাস্তম্ভে আবদ্ধ রয়েছেন ।যে শিলাস্তম্ভে বসে আত্মারাম ব্রহ্মচারী তপস্যা করছিল ,তাঁকে যেন নিয়ে এসে সেই শিলাস্তম্ভে প্রতিষ্ঠা করে ।ব্রহ্মানন্দ গিরি ব্রহ্মাচারীকেও যেন এখানে আনে ।এই পীঠে আমি করালবদনারূপে আবির্ভূত হব ।কালিকাদেবী আত্মারাম ব্রহ্মচারীকে আদেশে বলেন ,ব্রহ্মবেদির সন্নিকটে যে হ্রদ রয়েছে ,তার নৈঋত কোণে জলের তলদেশে শিলারূপে তার দক্ষিণ চরণের চারটি আঙুল রয়েছে ।তুলে এনে ব্রহ্মবেদির মূলে যত্নসহকারে রাখতে ।আর ব্রহ্মবেদির ঈশান কোণে গভীর অরণ্যের মধ্যে এই পীঠের অধীশ্বর লিঙ্গরূপে নকুলেশ্বর রয়েছেন ।তাঁর প্রকাশের ব্যবস্থা করতে ।আত্মারাম ব্রহ্মচারী নীলগিরি পর্বতে গিয়ে ব্রহ্মানন্দ গিরিকে সমস্ত জানালে সিদ্ধপুরুস্ব ,ব্রহ্মচারী ধ্যানস্ত হয়ে সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত হন ।অকস্মাৎ নীলগিরি পর্বতের পাদদেশে ,সমুদ্রে প্রবল ঝড় উঠে ।মায়ের নির্দেশ মত তাঁরা উভয়েই শিলাস্তম্ভের উপর উঠে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকেন ।অনুভব করতে থাকেন প্রবল ঝড়ের দাপটে তাঁদের নিয়ে শিলাস্তম্ভটি উড়ে চলেছে ।মায়ের নির্দেশে চোখ খুলে যখন দেখেন ,তাঁরা মহাপীঠ কালীপীঠ তথা কালীঘাটে এসে পৌঁছেছেন ।মায়ের আদেশ মত বারো হাত দৈর্ঘ বিশিষ্ট ব্রহ্মবেদির উপর পরম পবিত্র শিলাস্তম্ভটি প্রতিষ্ঠা করে পূজা অর্চনা সারেন ।পুরাণে বর্ণিত স্বয়ং ব্রহ্মার তৈরি মায়ের মুখমণ্ডল অলৌকিক ভাবে কালীহ্রদ থেকে মিলে ।ব্রহ্মানন্দ গিরি ও আত্মারাম ব্রহ্মচারী দুজনে মিলে ব্রহ্মবেদির উপরে একটি পর্ণ কুটির নির্মাণ করে মায়ের নিত্য পূজা ও জপ-তপে মগ্ন থাকেন ।কালীহ্রদের পশ্চিমে সামান্য দূরে প্রবাহিতা ত্রিভুবন তারিণী স্রোতস্বিনী মা গঙ্গা ।উত্তরে ও দক্ষিণে ঘন অরণ্য ।চৈত্র মাসের প্রত্যূষে একদিন পূজার ফুল তুলতে গিয়ে উত্তর পূর্বের ঈশান কোণে ঘন অরণ্যে ঢুকতেই এক বিস্ময়কর দৃশ্য দেখেন । একদল দুগ্ধবতী গাভি স্থির একস্থানে দাঁড়িয়ে ।বিস্ময়ে অদূরে দাঁড়িয়ে দেখেন ,তাঁদের স্তন হতে শুভ্র দুগ্ধ ঝরে পড়ছে একটি কৃষ্ণবর্ণ পাথরের উপর ।মন্দিরে ফিরে এসে ব্রহ্মানন্দ গিরি বসে ধ্যানমগ্ন হয়ে জানলেন ঐ উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণের প্রস্তরখণ্ডটি আসলে কালী মায়ের ভৈরব নকুলেশ্বর মহাদেব ।আত্মারাম ব্রহ্মচারী ,ব্রহ্মানন্দ গিরি ব্রহ্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে নকুলেশ্বর মহাদেবের নিত্য পূজার ব্যবস্থা করেন ও তার উপর একটি পর্ণ কুটির নির্মাণ করেন ।সহসা একদিন ব্রহ্মচারীদ্বয়ের কালীহ্রদে দৃষ্টি পড়তেই নজর কাড়ে ,জলের উপরে হীরের মত উজ্জ্বল তেজোদীপ্ত পদার্থ জ্বলজ্বল করছে ।তৎক্ষণাৎ মায়ের নির্দেশ আত্মারামের স্মরণে আসে ।কালবিলম্ব না করে কালীমায়ের নাম নিয়ে হ্রদে ঝাঁপিয়ে পড়ে ,জলের তলদেশে হতে সত্যযুগে পতিত প্রস্তরভূত মায়ের দক্ষিণ চরণের চারটি আঙুল তুলে আনেন ।পরের দিন শুভ স্নানযাত্রার পুণ্য তিথিতে পবিত্র দিব্য স্বর্গীয় বস্তুকে যথারীতি স্নান করিয়ে ,মায়ের আদেশ মত বেদির অগ্নিকোণে যত্নসহকারে রেখে পূজা অর্চনা করেন ।সেই থেকে প্রায় সাড়ে ছয় সের ঔজনের পাথরের মত দেখতে মায়ের চরণাঙ্গুলিগুলি আজও একটি লোহার সিন্ধুকে সযত্নে রাখা আছে ।
আত্মারাম ব্রহ্মচারী মহাপ্রস্থান করেন ।তারপর ভুবনেশ্বর চক্রবর্তী কালী মায়ের মন্দিরের পূজক নিযুক্ত হন ।গুরুদেব আত্মারামের আদেশে তিনি সংসারী হন ।তাঁদের একটি কন্যা সন্তান জন্মায় ।চক্রবর্তীর পরলোক গমনের পর জামাতা ভবানী দাস ,শ্বশুরের দায়িত্ব নিয়ে কালী মায়ের সেবাইত নিযুক্ত হয়ে মন্দিরের যাবতীয় সম্পত্তি ভোগদখল করতে থাকেন ।পরবর্তী সময়ে চক্রবর্তীর পুত্র পৌত্র ও দৌহিত্রগণ বংশ পরম্পরায় কালী মায়ের সেবাইত হন ।ভবানী দাসের পরবর্তী পঞ্চম পুরুষদের পর ১৭৪৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁ ,সেবাইত ষষ্টপুরুষদের পরিবারের সকলকে হালদার উপাধি দেন ।গোকুল হালদারের পুত্র গৌরীকান্ত ও তাঁর বংশধরদের সাথে জ্ঞাতিগণও হালদার পদবিতেই সুপরিচিত ।দুই ব্রহ্মচারীর বানানো পর্ণ কুটিরে বহু বছর ধরে মায়ের আরাধনা হয়ে আসছিল ।১৬ শতাব্দীর শেষের দিকে গুরুদেব ভুবনেশ্বর চক্রবর্তীর আদেশে যশোরের সামন্ত রাজা বসন্ত রায় একটি কাঠের মন্দির নির্মাণ করে দেন ।তারও বহু বছর পর ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে বরিষার জমিদার সাবর্ণ চৌধুরী ও কেশব রায়ের পুত্র সন্তোষ রায় কাঠের জীর্ণ মন্দিরটি ভেঙে বর্তমান মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু করেন ।হাটখোলার বিশিষ্ট ধনি ব্যবসায়ী রামহরি দাসের পুত্র কালীপ্রসাদ দাস ,তাঁর মায়ের শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণ ভোজন বাবদ পচিশ হাজার টাকা সমাজপতি সন্তোষ রায়ের হাতে দেন ।সকলের সম্মতিতে সন্তোষ রায় ঐ অর্থ কালী মায়ের মন্দির নির্মাণে ব্যয় করেন ।সময় লাগে দশ বছর ।কিন্তু মাতৃভক্ত সন্তোষ রায় নির্মাণ কাজ শেষ না হতেই সেই বছরই অর্থাৎ ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ইহলোক ত্যাগ করেন ।তাঁর অসমাপ্ত কাজ পুত্র রামনাথ ও ভাইপো রাজিব লোচন রায় ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে শেষ করেন ।খরচ হয় তিরিশ হাজার টাকা ।বাকি অর্থ জমিদার সাবর্ণ রায় মিটান ।মন্দিরের বাৎসরিক বিশেষ অনুষ্ঠান- স্নানযাত্রা ,জন্মাষ্টমী ,শারদীয়া মহাষ্টমী ,কালীপূজা ,রামনবমী ও বাংলা নববর্ষ উৎসব ।
উত্তর দক্ষিণে লম্বা সমান্তরাল মায়ের মন্দিরটি ।মোট একবিঘা এগারকাঠা তিনছটাক জমির উপর নির্মিত ।মূল মন্দির আটকাঠা জমির উপর ষাট হাত উঁচু ।বিস্তার প্রায় পঞ্চাশ হাত ।পশ্চিমে তোরণ দ্বারের উপরে নহবতখানা ।ব্রহ্মবেদির উপর শিলাস্তম্ভে প্রতিষ্ঠিত কালী মায়ের মুখমণ্ডল ।বহু ভক্ত ও গুণীজনেরা স্বর্ণ অলঙ্কারে মাকে ভূষিত করেছেন ।খিদিরপুরের বাসিন্দা ভক্তপ্রবর দেওয়ান গোকুলচন্দ্র ঘোষাল রূপার তৈরি মায়ের চারখানা হাত প্রদান করেন ।পরবর্তীকালে কলিকাতার এক ভক্ত কালীচরণ মল্লিক ,মায়ের হাত চারখানা সোনার গড়ে দেন ।মায়ের সোনার মুকুট দেন বেলেঘাটার রামনারায়ণ সরকার ।সোনার জিহ্বা বানিয়ে দেন পাইকপাড়ার রাজা ইন্দ্রচন্দ্র সিংহ বাহাদুর ।মাথার উপর শোভিত রূপার ছত্রটি উপহার দেন পড়শি নেপাল রাজ্যের প্রধান সেনাপতি যোগ্য বাহাদুর ।১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে মায়ের অলঙ্কারগুলি চুরি হয়ে যায় ।অনতি বিলম্বে ধনি ভক্তবৃন্দ পুনরায় মাকে স্বর্ণ অলঙ্কারে ভূষিত করেন । পরম পবিত্র কোষ্ঠী পাথরের উপর খোদিত মায়ের মূর্তিটি পাঁচ ফুট উঁচু ।ব্রাহ্ম মুহূর্ত হতে রাত এগারটা পর্যন্ত সদাজাগ্রত মায়ের নিত্য পূজা অর্চনা চলতে থাকে ।ব্রাহ্ম মুহূর্তে মায়ের মঙ্গল আরতি দিয়ে পূজা শুরু হয় ।মঙ্গল আরতির পর সন্দেশ ভোগ দিয়ে দর্শনার্থীদের সময় দেওয়া হয় ।সকাল আটটায় ফলমূল ও মিষ্টি দিয়ে মাকে বাল্যভোগ দেওয়া হয় ।বেলা তিনটিতে মন্দির পরিষ্কার করে চারটের মধ্যে নিবেদিত হয় অন্নভোগ ।সাথে রান্নাঘরে নারায়ণকেও ভোগ নিবেদিত হয় ।অন্নভোগে থাকে দশ সের আতবের ভোগ ,পাঁচ রকমের ভাজা ,সুক্ত ,নিরামিষ তরকারি ,ভাত ,ডাল ,মহাপ্রসাদ ,বলির পাঁঠার মাংস ,ছ্যাঁচড়া ,অম্বল ,দৈ ,পায়েস ও মিষ্টান্ন ।হালদার বংশীয় পরিবার এগুলো প্রস্তুত করেন ।তারপর হয় মায়ের বিশ্রাম ।এসময় মন্দির দ্বার বন্ধ থাকে ।এছাড়াও প্রতিদিন মন্দির প্রাঙ্গণে দরিদ্র নারায়ণ সেবার ব্যবস্থা থাকে ।তাতে দৈনিক একমন চাল ,পনের সের ডাল ও তরি তরিকারির বরাদ্দ থাকে ।তারপর রাতে গাওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি ,একটা ভাজা ও মিষ্টিসহ মাকে শিতলি দেওয়ার পর রাত এগারটায় সম্পূর্ণ মন্দির বন্ধ হয় ।বিশেষ পূজা ও পর্ব উপলক্ষে অনুষ্ঠানের পরিবর্তন ঘটে ।
আধুনিক সভ্যতায় কোলকাতা মহানগরীর আয়তন ও জন সংখ্যা বেড়েছে ।মায়ের মন্দিরে ভক্ত ও দর্শনার্থীর সংখ্যাও হয়েছে অজস্র ।তেমনি বেড়েছে মন্দিরের আয় ।শিবরাত্রি ,নীলষষ্টি ,নকুলেশ্বরের প্রধান উৎসব ।আগে চড়ক পূজা পালিত হত ।ব্রহ্মানন্দ গিরি নির্মিত নকুলেশ্বরের পর্ণ কুটিরের বহুকাল পরে ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে পাঞ্জাবের ভক্ত ,তারা সিংহ নামে এক ব্যবসায়ী স্বপনাদেশ পেয়ে সুদূর পাঞ্জাব হতে দামি পাথর বোঝায় নৌকা নিয়ে কাশী হয়ে কালীঘাটে পৌঁছান ।মায়ের করুণায় নকুলেশ্বর মন্দিরটি তিনি নির্মাণ করে দেন ।মন্দিরের প্রথম পাণ্ডা হন ভুবন মোহন পাণ্ডা ।বহুকাল ধরে বহু সাধক-সাধিকা এখানে এসে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছেন ।মায়ের মন্দিরের দক্ষিণে নির্মিত বিরাট নাটমন্দির ।নাটমন্দিরের দক্ষিণে হাড়িকাঠ ।তার দক্ষিণপশ্চিম কোণে রয়েছে যজ্ঞকুণ্ডু ।১২৪১ খ্রিষ্টাব্দে আন্দুলির জমিদার কাশীনাথ রায় ,মায়ের এই মন্দিরটি নির্মাণ করে দেন ।মায়ের মন্দিরের পূর্ব ও পশ্চিম কোণায় রয়েছে চারটি ভোগ রান্নার ঘর ।১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে গোরক্ষপুরের বাসিন্দা টিকর আয় দুটি রান্নাঘর নির্মাণ করেন । ১৮৪৩-১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে তারক চৌধুরী ও কাশীনাথ ব্যানার্জি অপর দুটি নির্মাণ করেন ।মায়ের মন্দির প্রাঙ্গণের পশ্চিমে রয়েছে প্রাচীন শ্যাম রায়ের যুগল মন্দির ।কালী মায়ের নিত্য পূজার মতই বিধিসম্মত ভাবে শ্যাম রায়ের সেবা ,পূজা অনুষ্ঠিত হয় ।শহর পত্তনির পূর্বে যে গোবিন্দপুর গ্রাম ছিল তা এই গোবিন্দ নাম থেকেই হয়েছে ।কালীঘাট মায়ের মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিমের সামান্য দূরেই ক্যাওড়াতলা মহাশ্মশান ।বহুকাল আগে এই শ্মশান ভূমিতে ক্যাওড়া বৃক্ষ জন্মাত ,তাই এই মহাশ্মশানের নাম ক্যাওড়াতলা হয় ।আগে শবদাহ হত মন্দিরের সামনে আদিগঙ্গার ঘাটে ।শ্মশানের লক্ষণ সমূহ সব এখানে বজায় থাকলেও গঙ্গা উত্তরবাহী না হয়ে দক্ষিণবাহী চলেছে ।বিরামহীন শবদাহের সদাজাগ্রত শ্মশানে শক্তি সাধক-সাধিকাদের তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের পক্ষে যথেষ্ট উপযোগী ও পবিত্র ।সেকালে পিশাচী ,দক্ষিণাচারী ,কাপালি করালি ও অঘোরী ,প্রভৃতি তন্ত্রসাধকরা এখানে তান্ত্রিক ক্রিয়াচার সম্পন্ন করেছেন ।নরবলি ও দিয়েছেন ।বহু সাধক-সাধিকা সিদ্ধি লাভ করে আশ্রম গড়ে জপ-তপে এখানে জীবন কাটিয়েছেন ।সমগ্র ভারতবর্ষের শৈব ,শাক্ত ,গাণ-পত্য ,সৌর ,ব্রহ্মগিরি সমস্ত ভারতীয় সাধনপন্থিরা ইচ্ছামত এখানে এসে সাধনা করে মায়ের দর্শন পেয়ে কৃপা লাভ করে ধন্য হয়েছেন ।তাঁদের মধ্যে ভগবান গাঙ্গুলি ,লোকনাথ ব্রহ্মচারী ,মাধবানন্দ শ্রীশ্রীবামাক্ষ্যাপা ,মা সারদামণি ,স্বামী বিবেকানন্দ ,মাতঙ্গময়ী ,শ্রীশ্রী রামঠাকুর ,ভোলানন্দ গিরি মহারাজ অন্যতম ।
প্রতি বছর গঙ্গাসাগরের বালুকাচরে কুম্ভমেলা বসে ।সাগর-সঙ্গমে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে কপিল মুনির আশ্রমের পবিত্র মন্দিরে পূজা দেন ।মেলা উপলক্ষে সাগরে যাতায়াতের পথে হাজার হাজার মনীষী ও মহাত্মাগণ কালীমায়ের দিব্য মূর্তি দর্শন করছেন ।
____________ রচনা-৩১/১২/২০২৪ ।। শব্দ সংখ্যা- ১,৮১৩
Comments
Post a Comment