মনসা মঙ্গল-৬-১৩
মনসামঙ্গল-৬
চাঁদ সদাগর থাকে, চম্পক নগরে।
মনসার সঙ্গে তার, ভীষণ বিবাদ।
দেবীর কোপেতে তার, ছয় পুত্র মরে।
তথাপি দেবতা হতে, তারে দিছে বাদ।
বহু কষ্ট পায় তবু, নাহি মানে হার।
চ্যাঙমুড়ি কানি তুই, দেবতা কি করে?
হেতাল দণ্ডিকা হস্তে, সদা থাকে তার।
মনসারে অন্বেষণ, করে ঘরে ঘরে।
একবার যদি দেখা, পায় তার সনে।
মারিবে মস্তকে দণ্ড, না বাঁচিবে আর।
আপদ ঘুচিবে তার, ভাবে মনে মনে।
পরম আনন্দ হবে, রাজ্যেতে তাহার।
এইভাবে কিছু দিন, ঘোরে ঘর ঘর।
না পাইল মনসারে, চাঁদ সদাগর।
মনসা মঙ্গল-৭
বাণিজ্যে চলিল শেষে, দক্ষিণের পানে।
শিবভক্ত শিব বলি, ডিঙ্গা যাত্রা করে।
মনের কৌতুকে চাপে, ডিঙ্গার তোরণে।
উচ্চস্বরে সদাগর, ডাকে নাবিকেরে।
চালাও নাবিক ডিঙ্গা, দক্ষিণের দিকে।
চাঁদের আদেশে চলে, সপ্তডিঙা লয়ে।
কালীদহে উত্তরিয়া, কহিল নাবিকে।
ক্ষণিক দাঁড়াও ওহে, নাও খানি লয়ে।
এদিকে মনসা দেবী আছেন বিষাদে।
বহু চেষ্টা করে দেবী, পুজা পাইবারে।
ধরাতলে পুজা নাই, কহে সিংহনাদে।
কেমনে পাইবে পুজা, কহে দরবারে।
চাঁদবেনে মোর সনে, সদা বৈর করে।
পুজা না পাইব আমি, এ সারা সংসারে।
মনসা মঙ্গল-৮
কালীদহে আছে চাঁদ, জানিল ধেয়ানে।
সপ্ততরী ডিঙা বায়, বাণিজ্য করিতে।
যুক্তি করে বিষধরী, যত সঙ্গী সনে।
বিপাকে ফেলিবে চাঁদে, তাহারে পুজিতে।
তবে যদি পূজা করে, চাঁদ সদাগর।
ডাকিল মনসা তবে, বীর হনুমানে।
কালিদহে করো গিয়া, ঝড় পরপর।
সাত ডিঙ্গা ডুবাইবে, কহি এইক্ষণে।
কালীদহে করো গিয়া, প্রবল সমীর।
পুষ্প পান দিয়া দেবী, তার প্রতি বলে।
জোড় হাতে হনুমান, হয়ো না অধীর।
চাঁদবেনে সাত ডিঙ্গা, ডুবাইব জলে।
দেবীর আদেশে চলে, বীর হনুমান।
বিপাকে পড়িল চাঁদ, বিধির বিধান।
মনসামঙ্গল - ৯
দেবীর আজ্ঞায় তবে যায় হনুমান।
সাথে ছিল মেঘগণ, পুষ্কর দুস্কর।
করে ঝড় বরিষন, হয়ে বলিয়ান।
সপ্ত ডিঙ্গা ডুবাইবে, জলের ভিতর।
কালীদহে মেঘবৃষ্টি, ঝড়ের গর্জন।
মহারোষে হনুমান, বাতাসের ভরে।
করিবার ঝড় বারি, উপস্থিত হন।
অবনী আকাশ ঢাকে, ঘন অন্ধকারে।
প্রখর বাতাস ঝড়, প্রচণ্ড তুফান।
চাঁদসদাগর ভাবে, নাহিক নিস্তার।
ঘন ঘোর তর্জনের, নদে আসে বান।
বলে চাঁদ সদাগর, ভাসিল সংসার।
না দেখিব রাজ্য আর, এই বুঝি শেষ।
ভিনরাজ্যে মরি শেষে, না পাইব দেশ।
মনসামঙ্গল-১০
বলিছে নাবিক শ্রেষ্ঠ, ওহে ভোলানাথ।
ভাঙ্গিল মাথার খুলি, ঝড়ের তাণ্ডবে।
দেখি যে অদ্ভুত রীতি, কহে চন্দ্রনাথ।
হাসিছে বিদ্যুৎ মেঘে, ভীষণ গরবে।
বিপদ আসিল কেন, উজ্জ্বল দুপুরে।
দোলে সপ্ততরীখান, চক্রাবর্ত পাকে।
বলিছে নাবিক কাঁদি, চাঁদ সদাগরে।
মাস্তুলে চাপিয়া হনু, ঘোরে চক্রপাকে।
ঘন ঘন ঘুর্ণী ঝড়ে, ছই গেল উড়ে।
প্রবল পবন ভয়ে, হাঙ্গর কুম্ভীর।
জলের উপরে ওঠে, ওড়ে যেন ঝড়ে।
ডিঙ্গা লয়ে চক্রাকারে, হনুমান বীর।
কাঁদিয়া সকলে জলে, ঝাঁপ দিয়া পড়ে।
মেঘের গর্জনে কাঁপে, মরে যেন ঝড়ে।
মনসামঙ্গল-১১
কালীদহে ডুবু ডুবু, সপ্তডিঙ্গা তরী।
মনসার নাম তবু, মুখে নাহি বলে।
বাঁচাইবে মহাদেব, কহে পণ করি।
বধিব পরানে আমি, মনসারে পেলে।
যত বলে এই সব, কোপে হনুমান।
হুড়মুড় ঝড় বৃষ্টি, বৃদ্ধি হতে থাকে।
শেষকালে ডুবে গেল, সাত জল যান।
কালিদহে মাঝখানে, বাঁচাইবে কাকে?
জলের উপরে ভাসে, চাঁদ সদাগর।
বিপদ সাগরে কানি, ডুবাইল নায়।
খলখল হাসে কানি, বিষ বিষহর।
তবু না কহিল চাঁদ, নোনা জল খায়।
জয় জয় বিষহরী, তুমিই ভরসা।
চর্তুদশ পদে রচে, মঙ্গল মনসা।
মনসামঙ্গল-১২
কেউ পড়ে লম্ফ দিয়া, কালিদহ জলে।
চক্রাবর্তে ঘোরে ডিঙ্গা, চাঁদ কম্পমান।
শিরে হস্ত দিয়া কাঁদে, থই থই জলে।
সকল ডুবিল জলে, বাঁচিবে না প্রাণ।
ভাঙা ডিঙ্গা কাঠকুটো, ধরিয়া সকলে।
দেখিয়া হাসেন রথে, মহা বিষহরী।
প্রাণ রক্ষা করিবে কি, চেঙমুড়ি কানি।
পেটভরে জল খায়, চাঁদ অধিকারী।
চক্ষু রাঙ্গা ভরা পেট, খাইয়া চুবনি।
চাঁদ সদাগর ভাসে, কালিদহ জলে।
তবু বলে দুঃখ দিলি, চেঙমুড়ী কানি।
এমন দুর্গতি তার, মনসা দেখিলে।
বসিবারে শতদল, দিলে ফেলাইয়া।
জল খেয়ে রক্ত চক্ষু, সকল বুঝিয়া।
মনসামঙ্গল-১৩
হেনকালে সম্মুখেতে, দেখে পদ্মফুল।
চাঁদ বলে ওই পদ্ম, জন্ম মনসায়।
ওই পদ্ম পরশিয়া, করিব না ভুল।
এত ভাবি সদাগর, না ছুঁইয়া যায়।
জল খেয়ে চাঁদ বোঝে, মনসার খেলা।
এমন দুর্গতি দেখে, কশ্যপ তনয়া।
ভেসে আসা কলাগাছ, করে দেয় ভেলা।
ভেলায় চাপিয়া চাঁদ, তীরে নামে গিয়া।
শিব শিব বলে চাঁদ, গড় করে শিবে।
নেতো সে ধোপানী ঘাটে, বলিল হাসিয়া।
প্রণমিলে চাঁদবেনে, কেন মহাদেবে,
বাঁচাল মনসা দেবী, দেখেছি বসিয়া।
সঙ্কটে ফেলিছে কানি, উদ্ধারিবে বলে।
চেঙমুড়ি কানি কেন, এত মোরে ছলে।
Comments
Post a Comment