কর্ণ কৃষ্ণ সংবাদ
কর্ণ কৃষ্ণ সংবাদ
দেবপ্রসাদ
দুর্যোধন, পাণ্ডবের দূত শ্রীকৃষ্ণকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলো, শ্রীকৃষ্ণ মন্ত্রী বিদূরের অতিথি হয়ে এলেন, কৃষ্ণ কাকা কাকীর অমৃত ব্যঞ্জন খাওয়া শেষ করে দুপুরের বিশ্রাম নিচ্ছেন, রক্ষী এসে খবর দিলো অঙ্গরাজ কর্ণ দেখা করতে এসেছেন, বিদূর বললেন আমি এখন ব্যস্ত আছি, বাড়িতে অতিথি এসেছেন, দেখা হবে না কাল রাজসভায় দেখা করব। দূত তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন উনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দর্শন চাইছেন। বিদূর শ্রীকৃষ্ণের দিকে তাকাতেই কৃষ্ণ বললেন ওনাকে স্ব-সম্মানে নিয়ে এসো, দূত চলে গেল, বিদূর অবাক হয়ে কৃষ্ণকে বললেন, একি লীলা ভগবান? শত্রু পক্ষের সব থেকে শক্তিশালী যোদ্ধা, যার বীরত্বে সারা পৃথিবী কম্পমান, তার কি জন্য, সামান্য পাণ্ডবের দূতের সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন হলো? (কৃষ্ণের ঠোঁটের কোনে হাসি, ) বিদূরের কথা শেষ হলো না কর্ণ এসে প্রণাম জানালেন,
"ভগবান মধুসুদন আমার সাদর প্রণাম গ্রহণ করবেন", আমি গতকালের ঘটনার জন্য দুর্যোধনের হয়ে ক্ষমা চাইতে এসেছি, দুর্যোধন অবোধ, উত্তপ্ত মস্তিষ্ক, কম বোঝে, ও জানে না দূতের সঙ্গে কি রকম ব্যবহার করতে হয়, আপনি আমার বন্ধুকে ক্ষমা করে দেবেন। সব শুনে শ্রীকৃষ্ণ বললেন - আর এখন ক্ষমা চেয়ে কি হবে অঙ্গরাজ, যুদ্ধের দামামা তো বেজে গেছে, তৈরী হচ্ছে কুরুক্ষেত্র, এত অহঙ্কার, এত বিদ্বেষ কিসের জন্য অঙ্গরাজ? সামান্য পাঁচটা গ্রাম, তাও দুর্যোধন দিতে পারল না? রক্তপাত, আত্মীয় স্বজনদের বলি দিতেই হবে এবার, কলি বাসা করেছে ওর মস্তিষ্কে, এখন তৈরি হচ্ছে রক্তস্রোত বাহিত হওয়ার মহানদী, কে বাঁচাবে? তুমি জানো না পঞ্চপাণ্ডবের বীরত্ব? হে কর্ণ রক্তস্রোতে ভাসবে হস্তিনাপুর। কত অনুনয় বিনয়ে দুর্যোধনকে বোঝালাম, মাত্র পাঁচটা গ্রাম, দিয়ে দিলে তুষ্ট হতো পাণ্ডব। এই বলে কৃষ্ণ কিছুক্ষণ নীরব হলেন, তারপর বললেন চলো কর্ণ আমাকে হস্তিনাপুরের সীমান্ত পযর্ন্ত পৌঁছে দাও, কিছুকথা আরো হোক তোমার সাথে, এরপরতো শত্রু। কর্ণ নিজের রথে বসালেন কৃষ্ণকে নিজে হলেন সারথী, কর্ণ তো সারথীর ছেলে তিনি জানেন কি করে গুণী ব্যক্তির সম্মান করতে হয়, অভিজাত ব্যক্তির কদর করতে হয়, কিন্তু কৃষ্ণ পিছনে না বসে সামনে কর্ণের সাথে বসলেন, কৃষ্ণ ও রাজার ছেলে তিনিও যোগ্য ব্যক্তির সম্মান করতে জানেন, তার থেকে ভালো জানেন, কর্ণ একমাত্র যোদ্ধা যিনি পারেন কুরুক্ষেত্রে পাণ্ডবদের পরাজিত করতে, যার বীরত্বের ওপর নির্ভর করে দুর্যোধন এই পদক্ষেপ নিতে পেরেছে যদি কর্ণকে এই যুদ্ধ থেকে সরিয়ে নেওয়া যায় বা কর্ণের মনোবল নষ্ট করে দেওয়া যায় তবে পাণ্ডবদের আর কেউ পরাস্ত করতে পারবে না। কিছু দূর চলল রথ দুইজনে মৌন, কৃষ্ণ মৌনতা ভঙ্গ করে বললেন, আমি চলে যাবো শুরু হয়ে যাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি। কিন্তু একটা কথা তুমি জানো না কর্ণ, তোমার এই সৌর্য্য এই যে ক্ষত্রিয়ের মতো বীরত্ব, কিসের জন্য? আসলেই তুমি ক্ষত্রিয়, তুমি শুনে দুখী হবে না সুখী হবে জানি না, নাকি যুদ্ধের আগে নিজেকে দুর্যোধনের থেকে সরিয়ে নেবে, কর্ণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্রী কৃষ্ণের দিকে, কৃষ্ণ বলে চলেছেন - তুমি এক উচ্চ বংশের সন্তান, পাণ্ডব মাতা কুন্তী তোমার গর্ভধারিনী। তুমি পাণ্ডব জ্যেষ্ঠ, সূর্য পুত্র, কুন্তীর বিবাহ পূর্ব সন্তান, কলঙ্কের ভয়ে পিসি কুন্তী তোমাকে নদীবক্ষে ভাসিয়ে দেন, এখন বলো এই ধর্ম যুদ্ধে তোমার অবস্থান কোথায়? দুর্যোধন না পাণ্ডব, একদিকে প্রাণপ্রিয় সখা, অন্যদিকে পাঁচ সহোদর, দুর্যোধন তোমাকে দেবে এক অনিশ্চিত জীবন, আর পাণ্ডব, আপন পাঁচভাই, এখানে ভারতের সম্রাট হবে তুমি, যুধিষ্ঠির তোমার শিহরে চামর দোলাবে, ভীম তোমায় পাদুকা পরিয়ে দেবে, অর্জুন হবে তোমার দ্বারপাল, সেনাপতি, নকুল সহদেব, তোমার অঙ্গরক্ষক, সে হবে এক অতুলনীয় সন্ধিক্ষণ। শ্রীকৃষ্ণ কথা গুলো বলে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। কর্ণ তখনো কিংকর্তব্যবিমূঢ়, বুঝতে পারছে না কি বলবেন, এ তার জীবনে কি চলছে? একদিকে অসময়ে সাথ দেওয়া প্রাণপ্রিয় বন্ধু, অন্যদিকে আপন সহোদর, ভগবান ইনি, ইনি জানেন সব, ইনি মিথ্যাচার করার পাত্র নন। যুদ্ধের পরিনতি ইনি জানেন। মুখ খুললেন কর্ণ- ভগবান এই অস্থির সময়ে আপনি আমাকে যে পরিস্থিতে ফেললেন. তাতে কি আমার দুর্যোধনের থেকে সরে আসা উচিত? তার বন্ধুত্বের এই প্রতিদান দেবো আমি? ধর্ম হোক বা অধর্ম বন্ধুকে তার দুঃসময়ে ছেড়ে চলে আসাও কি ধর্ম হবে? যে ভুল আমার গর্ভধারণী করেছিলেন আমিও কি সেই ভুল করব? আজ কেন এই সত্য প্রকাশ করলেন ভগবান। আমি কিভাবে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়াব আমার সহোদরদের সম্মুখে? কোন অস্ত্রে বধ করব তাদের? যে রক্ত তাদের বক্ষ হতে বেরিয়ে আসবে, সে রক্তে যে আমার রক্ত মিশে থাকবে ভগবান। হে কৃষ্ণ আমাকে নিয়ে যে কূটনৈতিক খেলা খেললেন, তাতে কুরুক্ষেত্রে, যুদ্ধ শুরুর আগেই কৌরবদের পরাজয় হলো কিনা? নাকি ভগবান হয়েও আপনি আমার সঙ্গে মিথ্যাচার করছেন? পাণ্ডবদের যুদ্ধে জয় আনার জন্য আমাকে সরিয়ে দিতে চাইছেন? পাণ্ডবের মাতা কুন্তী রাজমাতা তাঁর নামে এই কলঙ্কজনক উক্তি আপনাকে পাপের সমুদ্রে পতিত করবে কিনা? একবার ভেবে দেখেছেন? সময়চক্রে ইতিহাস আপনাকে কোন স্থানে দাঁড় করাবে প্রভু? এসব প্রশ্নের পরে কর্ণ নীরব হলো। হস্তিনাপুরের সীমান্তে কর্ণ রথ থেকে নেমে গেলেন। কর্ণ নীরবে তার নিজের রথে বসলেন। কৃষ্ণ দূরে বহুদূরে চলে গেলেন।
Comments
Post a Comment