দ্রোণ আচার্য
দ্রোণাচার্য
অভিশপ্ত পলাশ
কলকাতার গতানুগতিক জীবনে যখন অস্থির হয়ে উঠছিলাম, তখন আমার এই ভবঘুরে মনে ইচ্ছে জাগল, দূরে কোন নির্জন স্থানে নিজেকে লুকিয়ে নেওয়ার।
এক কাক-ডাকা ভোরে বেরিয়ে পরলাম ছায়াসুনিবিড় সবুজে ঘেরা অযোধ্যা পাহাড়, বাগমুন্ডী জলপ্রপাত, আর ছৌনাচে'র দেশ পুরুলিয়াতে ।
কলকাতা থেকে পুরুলিয়ার রেল দুরত্ব প্রায় ৩২২ কিলোমিটার । প্রায় আট ঘণ্টা ট্রেন জার্নির পরে, স্বপ্নের পুরুলিয়া স্টেশনে নামলাম। সঙ্গী ছিল আমার এক সঙ্গী। কলকাতাতে, আমাদের অফিসের পিয়ন। ছেলেটি সাঁওতাল পরিবারে জন্ম হলেও বেশ পরিপাটি। আমার সঙ্গেই থাকে, আমার রান্নাবান্না করে দেয়। ওর নাম ভুতু হলেও ভালো নাম একটা আছে।
পুরুলিয়া স্টেশন থেকে আমরা একটা ভাড়া করা গাড়ি করে রওনা হলাম অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে। একটা অজানা উৎকন্ঠা এবং কৌতুহল যেন মনকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। জানালা দিয়ে শাল পিয়ালের বন, সর্পিল চড়াই উৎরাই রাস্তার দুই পাশের সুউচ্চ পাহাড়ের মনমোহিনী এবং নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা পূর্ব নির্ধারিত একটি আদিবাসী গ্রামে এসে পৌছলাম।
গ্রামটির নাম বেগুনকোদর। সেখানে ভুতুর বাড়ি। আমি ওকে ভুতু বলেই ডাকি। গ্রামটি পুরুলিয়া স্টেশন থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে গা ছমছমে একটি গ্রাম । চারিদিকে ঘন অন্ধকার আর ঘন জঙ্গল। স্থানীয় কয়েকজনের মুখে শুনলাম গ্রামটি নাকি 'ভুতের রাজ্য'। চারপাশের গহীন অরণ্য দেখে আমারও তাই মনে হলো। গ্রামটি অযোধ্যা পাহাড়ে পরিবেষ্টিত।
ভুতুর বাবা খুবই দরিদ্র, ওর মা পাহাড় থেকে কাঠ কেটে কখনও বা শাল পাতার ঠোঙা তৈরি করে বাগমুন্ডির হাটে বিক্রি করে আর বাবা জনমজুরের কাজ করে, তাও সারা বৎসর কাজ থাকে না ।
খুবই কায়ক্লেশে ওদের জীবন যাপন। কিন্তু আমার জন্য আতিথেয়তার কোন ত্রুটি রাখেনি ভুতুর মা। জীবনে এইরূপ অথিতি আপ্যায়ন আমি আগে কখনও দেখেনি। মনে মনে ভাবলাম এই পরিবারের কাছে কলকাতার শিক্ষিত বাবু সমাজের আতিথেয়তার ব্যপারে অনেক শেখার আছে।
রাতে ভালো ঘুম হলো না, যদিও ভুতু তার ব্যতিক্রম ছিল। কয়েকদিন আগে নাকি এই গ্রামটি বাঘের আতঙ্কে জনমানবশূন্য ছিল। তাছাড়া বুনো হাতির উপদ্রব তো আছেই। মাঝে মাঝে শিয়ালের ডাক। জঙ্গলের অদ্ভুত অদ্ভুত পাখির ডাকের শব্দে আমি নিদ্রাহীন আতঙ্কে রাত কাটালাম।
পরদিন আমরা পাশেই মুরগুমা গ্রামে ঘুরতে গেলাম। অযোধ্যা পাহাড়ের উপরে শাল পিয়ালের জঙ্গলে ঘেরা গ্রামটি । পাশেই মুরগুমা জলাধার বা ড্যাম। অপূর্ব দৃশ্য নিচে জলাধার দিকে তাকালে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। যদি কেউ সেখান থেকে পড়ে যায় তাহলে তার অস্তিটুকো পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্থানীয় লোকজন এই জায়গাটিকে sucide point বলে ।
কিছুটা সময় সেখানে কাটানোর পরে আমার মনে কিছু লেখার ইচ্ছে জাগল। সাথে সাথেই মোবাইল খানা বের করে নিজেকে সাহিত্য সাগরে ডুবিয়ে দিলাম। হঠাৎ একটি শীতল হাতের স্পর্শে আমি যেন জেগে ওঠলাম । পিছনে তাকিয়ে দেখলাম একটি মেয়ে। বয়স কুড়ির মতো হবে । শালপাতা দিয়ে বানানো ঠোঙায় কিছু মুড়ি ও চপ বিক্রি করছে।
ও বললো ,
"এ বাবু খাবার খাবি? আমি মুড়ি এনেছি বটে"
আমি অপলক দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। কি অপূর্ব তার রূপ, তামাটে রঙের ভেতর দিয়ে মনে হয় চাঁদের জোছনা ছিটকে বেরিয়ে আসছে। একটা ডোরাকাটা শাড়ি আঁটোশাঁটো করে যেন জোছনাটাকে বেঁধে রেখেছে, ব্লাউজহীন শাড়ি জড়ানো, অথচ কি শোভনীয় মার্জিত তার আভরণ। যৌবনের উন্মত্ত উন্মাদনাকে অচিরেই হত্যা করে।
ভাবলাম এই বয়সে বাচ্চারা শহর কলকাতায় স্কুলে যায়, এগরোল,মোগলাই,পিৎজা্ বার্গার খেতে চায়, আর এই আদিবাসী মেয়েটি খিদে মেটাতে মুড়ি কেনার জন্য হাতে বানিয়ে ফুল বিক্রি করছে।
কালক্ষেপণ না করে পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট ওর হাতে দিলাম। মেয়েটি বলল,
--"এ বাবু তুই কি বোকা আছিস বটে ?
--এত্তো টাকা দিচ্ছিস ক্যানে ? এ ফুলের দাম মাত্র পাঁচ টাকা। আমার কাছে তো আর টাকা নাই যে তোকে ফেরত দেবো"
---"আজ কেউ কিনছে না ফুল।
---+একদম বিক্রি নেই রে -----"
আমি বললাম
--" তোর বাকি টাকা দিতে হবে না , তুই সব টাকা নিয়ে নে'
"আমি তোকে ভালোবেসে দিলাম"
মেয়েটি বলল,
--"না বাবু মায়ের নিষেধ আছে, কারোর দানে না নিতে"
তোর নাম কী ?
"সরস্বতী কাঞ্জিলাল"
এই বলে মেয়েটি একটি ফুল আমাকে দিয়ে এক দৌড়।
আমি জোরে চিৎকার করে বললাম,
"টাকা টা নিয়ে যা----"
ও পিছনে না তাকিয়েই বললো
----"ওটা তোকে দিলাম বাবু"
"তুই খুব ভালো মানুষ আছিস --রে"
(৪)
আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম আর নিজের অজান্তেই ফুলটাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরলাম। কৃষ্ণাঙ্গী দেহ হলেও মেয়েটির চোখ দুটি যেন আভিজাত্যে মোড়ানো একটি আগ্নেয়গিরি যার উষ্ণ মানবিক লাভায় শহর কলকাতার শিক্ষিত সমাজ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে ।
কিন্তু কে এই মেয়ে টি ?? এই গহীন পাহাড়ের জঙ্গলে তো সাঁওতাল আদিবাসীদের বসবাস । এখন বাঙালি কাঞ্জিলাল পরিবার কিভাবে আসবে?? ক্ষণিকের জন্য যেন মেয়েটা আমাকে হতবাক করে দিল । ওকে আমার সাঁওতাল পরিবারের বলে মনে হলো না একদম। মূহুর্তের মধ্যেই মেয়েটি পাহাড়ের গভীর জঙ্গলের পথ ধরে আমার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। কিন্তু ওকে কাছে ডেকে একটু কথা বলার তীব্র আকাঙ্খা আমার মনকে যেন পাগল করে তুলল । এরকম তো আমার আগে কখনও হয়নি?
আমার মনের ইচ্ছেটা সম্ভবতঃ পাশে থাকা ধনঞ্জয় বুঝতে পেরেছিল, তাই হটাৎ বলে উঠলো,
"বাবু এই মেয়েটিকে আমি চিনি" ।
"ওকে সবাই সরু বলেই চেনে গো"
------ ও থাকে তো টুডু পাড়ায় । ওর বাপ টো পাহাড় থেকে পড়ে মইরে গ্য্যছে গো বাবু" ওরা বড়ো অভাগী গো বাবু
---- বড় দুখি ওরা "
"কেন কি হয়েছে ওদের?" খুব আগ্রহ নিয়ে ধনঞ্জয়কে আমি জিজ্ঞেস করলাম।
(৫)
আমার কৌতুহল দেখে ধনঞ্জয় এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে লাগলো ----
সে অনেক আগের কথা। ওর বয়স যখন এক বছর তখন ওর মা এই টুডু পাড়ায় আসে, জানা গেছে ওর বাবা নাকি ওদের পাহাড় দেখানোর নাম করে এই মুরগুমা জলাধারের নির্জন প্রান্তে নিয়ে আসে । সরস্বতীকে কোলে নিয়ে যখন ওর মা ড্যামের পাশে ঘুরছিল তখন ওর বাবা ওদের দুজনকে ধাক্কা দিয়ে পাহাড়ের উপর থেকে ফেলে দেবার জন্য উদ্যত হয়, তখন বিধাতার নির্মম পরিহাসে সে নিজেই একটি পাথরের সাথে ধাক্কা খেয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে যায় আর ওর মা আতঙ্কে, ভয়ে, দুঃখে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
ঠিক সেই সময় রামচরণ মুর্মু নামে একজন জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে বাড়ি ফিরছিল। সে ওদের এই নির্জন পাহাড়ি ড্যামের ধারে পড়ে থাকতে দেখে তার ঘরে ওদের নিয়ে আসে । এবং রামচরণের অক্লান্ত সেবা শুশ্রূষায় প্রায় দুদিন পড়ে ওরা দুজনেই সুস্থ হয়ে ওঠে ।
কয়েকদিন পরে নাকি একটি পচাগলা মৃতদেহ ড্যামের ধারে পড়ে থাকতে দেখে ওর মাকে খবর দেওয়া হয় । ওর মা গায়ের জামা দেখে চিনতে পারে এটা তার স্বামী । সেদিন থেকে ওর মা কপালের সিঁদুর মুছে ফেলে ।
(৬)
ওর মা জানিয়েছিল সে নাকি বাবা মায়ের অজান্তে এক কাপরে পালিয়ে এই লম্পট লোকটাকে বিয়ে করে । কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পরে বুঝতে পারে লোকটা একটি
প্রতারক । এর আগেও নাকি একাধিক বিয়ে করেছে। চালচুলোহীন অকর্মণ্য একটি লোক মেয়েদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে বিয়ে করত। তারপর তাদের দিয়ে কাজ করাযত আর সেই টাকায় নিজে নেশা করত আর
জুয়া খেলত । সংসারের কোন খরচ পর্যন্ত দিত না । ওর মা সেলাই করে সংসার চালাতো ।
ওর মা নিরুপায় ছিল । তার শ্যাম ও কুল কিছুই
থাকল না । সে সরস্বতীর কথা ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে তার সংসার আগলে ছিল । বাপের বাড়িতে যাবারও তার মুখ ছিল না । তার বাবা মা তাকে চিরদিনের মতো ত্যাগ করে দিয়েছে । ওরা ধানবাদের একটা বস্তিতে থাকত ।
সরস্বতীর তখন এক বছর । বিপত্তি তখনই হয় যখন ওর লম্পট বাবা আর একটা বিবাহ করে । ওর মা প্রতিবাদ করায় ভাগ্যে জুটেছিল নির্মম অমানুষিক নির্যাতন । তাই ওর বাবা ওকে আর ওর মাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে পথের কাঁটা দূর করতে চেয়েছিল ।
(৭)
ওর মা মনের দুঃখে বলেছিল যে তার কোথাও যাবার যায়গা নেই। সে মেয়েকে নিয়ে আত্মহত্যা করবে ! তার জীবন কাহিনী শুনে রামচরণ তাকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়।
রামচরণের সংসারেও আপনার বলতে কেউ নেই, মা বাবা বছর খানেক আগে গত হয়েছেন । এই কদিনে তারা দুজনে দুজনকে কিছুটা ভালও বেসে ফেলেছিল বোধ হয় ।
তাই আদিবাসী নিয়মানুযায়ী ধুমধাম করে গ্রামের মুরব্বীদের উপস্থিতিতে বিবাহ সুসম্পন্ন হয়।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে রামচরণ মুর্মু বছর চারেক আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় । তারপর একমাত্র কন্যাসন্তানকে নিয়ে রাম চরণের ওই ভাঙা ঝুপড়িতেই ওরা কায়ক্লেশে দিনাতিপাত করছে। ওর মা শাল পাতা দিয়ে থালা তৈরী করে বাজারে বিক্রি করছে আবার কখনো জনমজুরীও খাটে।
৮)
ধনঞ্জয়ের মুখে সরস্বতীর জীবন কাহিনী শুনতে শুনতে নিজের অজান্তে চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না।
ধনঞ্জয়কে বললাম, "হ্যাঁরে ধনঞ্জয় আমাকে একটু টুডু পাড়ায় সরস্বতীদের ঝুপড়িতে নিয়ে যাবি ?"—:
-- "হ্যাঁ বাবু, কিন্তু আজ ক্যানে ?"
"আমারা তো আজ পঞ্চকোট পাহাড় দেখতে যাব বাবু"
আমি জিদ ধরলাম
"না আজই ওই মেয়েটার বাড়ি যাব, ওর ফুলের দামটা না দেয়া পর্যন্ত ঘুরে শান্তি পাবো না"
ধনঞ্জয়ের খানিকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেই একপ্রকার রাজি হলো।
---_-"চলুন বাবু"
-----"হ্যাঁ চলো"
(৯)
পড়ন্ত বিকেলে পাহাড়ের ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা উঁচু নিচু পায়ে চলা পথ অতিক্রম করে একটা ছোট্ট পাড়ায় এসে পৌঁছালাম পাড়া বললে ভুল হবে একটা বস্তি বলা যেতে পারে, সর্বসাকুল্যে ২০/২৫ ঝুপড়ি হতে পারে।
একটা ছোট্ট বাচ্চা কে জিজ্ঞেস করায় সে সরস্বতীদের ঘরটা দেখিয়ে দিল। আমারা সেই ঘরটির কাছে যেতেই একজন মহিলা ঘোমটায় মুখ ঢেকে ঘরের মধ্যে চলে গেল।
আমি বললাম
---"একটু শুনবেন, আমি সরস্বতীকে ফুলের দাম দিতে এসেছি"
সে কোন উত্তর দিল না বরং সে যে ঘরের মধ্যে গিয়ে যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে তা আমরা স্পষ্ট শুনতে পেলাম
আমার জিজ্ঞাসু মন ব্যাকুল হয়ে উঠল নিমেষের মধ্যে।
হটাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে কাঁদতে কাঁদতে সে বলে উঠলো
---"ও ভাই, ভাই আমার"!!
----মা-বাবা কেমন আছে ? সে যেন আরো উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলো।
আমার সর্বাঙ্গ যেন শীতল হয়ে গেল। এই রকম যাগায় আমাকে কে ভাই বলে ডাকলো ?
------কে ,??, কে ইনি ?
( ১০)
আমি বিদ্যুৎবেগে ঘরের মধ্য ছুটে গেলাম, তারপর যা দেখলাম আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না ---এ কে ?
এ যে আমার নিজের বড় দিদি !
আমি যেন নির্বাক নিস্তব্ধ নিথর হয়ে গেলাম।
দিদিকে এই অবস্থায় দেখে কান্না ধরে পারিনি সেদিন ।
দশ বছর আগে দিদি পালিয়ে বিয়ে করার পর থেকে তার সাথে আমাদের বাড়ির আর কোন সম্পর্ক ছিল না । দিদির কোন খোঁজ খবরও আমাদের বাড়ি থেকে নেওয়া হয়নি মানসম্মানের দিকে তাকিয়ে। সে একটা অজ্ঞাতকুলশীলকে সবার অমতে বিয়ে করে বাড়ির সন্মান নষ্ট করেছিল । আর এইভাবে ক্রমে ক্রমে দিদির পরিচয় আমাদের বাড়ির সবার মন থেকে মুছে গিয়েছিল ।
আর এই দিদি একটা সময় আমাকে কতই না ভালবাসতো । শুধু ওই একটা লম্পট জানোয়ারের কারণে দিদির জীবন টা তছনচ হয়ে গেল।
"ইতিমধ্যে সরস্বতী দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো
-----"মা আজ ফুল বিক্রি হয় নি, মুড়িও কিনতে পারিনি"
তৎক্ষণাৎ আমাকে দেখেই বললো ।
----"এ বাবু আমার ফুলের দাম লাগবেনা রে"
----"আমি তোকে বিনি পয়সাতেই দিয়েছি"
দিদি বলল
----সরু, সুরু সরু রে
----উনি তোর মামা হন ।"
শোনা মাত্রই ও আমাকে
ষষ্টাঙ্গে প্রনাম ঠুকল ।
আমি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম । তারপর দিদির পা দুটো ধরে বললাম
-----"দিদি তুই তৈরী হয়ে নে, এক্ষুনি আমার সাথে কলকাতা যাবি । আমি এতদিন তোকে অনেক খুঁজেছি ।আমি সরস্বতীকে স্কুলে ভর্তি করে দেব"
দিদি বলল
----"তা আর হয় না ভাই।
তাহলে সরুকে ?
কথা শেষ হতে না হতেই জবাব দিলো,
--------"না তা হয় না,ও চলে গেলে আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো ?"আমি আত্মদ্বন্দ্বে পরাভূত এক সৈনিক। মা বাবা কে কষ্ট দিয়ে আমি যে অন্যায় করেছি তার জন্য কঠিনতম শাস্তি পেয়েছি। আমি এখানে ভালই আছি । তাছাড়া এই পাহাড়ীরা সহজ সরল আদিবাসী মানুষগুলো আমাকে খুবই ভালবাসে। এটা আমার ভবিতব্য। আমার ফেলে আসা জীবনকে আর আঁকড়ে ধরতে চাই না ভাই, তুই আমাকে দুর্বল করে দিস না, যদি পারিস আমার মৃত্যুর পরে এই হতভাগিনী কে একটু দেখিস, ওর এই জগতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই রে"
বলতে বলতে দিদি কাঁদতে লাগলো। আমিও সামলাতে পারলাম না। আমাদের এই দুই ভাই বোনের কান্নায় চারিপাশের কঠিন পাহাড় ও যেন বিগলিত হয়েছিল সেদিন।
(১১)
আমি জানি দিদিকে আর ফেরান সম্ভব নয়, কারণ সে বরাবরই খুবই একরোখা প্রকৃতির।
অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও দিদি আমার সাথে কলকাতা যেতে রাজি হয় নি। কিছু টাকা দেবার চেষ্টা করলাম কিন্তু তাও সে গ্রহণ করল না ।
দিদির কাছে সেই রাতটা কাটালাম । মনে মনে ভাবলাম একেই বলে নিয়তি, যেটা ঈশ্বর নির্ধারণ করেন, যেখানে মানুষের কোন হাত নেই, নেই কোনো ইচ্ছা অনিচ্ছার মান্যতা। হৃদয়ের গভীর থেকে একটা চাপা আর্তনাদ যেন মনকে অস্থির করে তুলল। কি করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না । কি করে দিদিকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে যাই ? আমার সেই প্রতিমার মত দিদির আজ এ কোন অবস্থা ? আমি মা বাবাকে কী বলবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
আমার বাবা একটা হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আমাদের চার ভাই বোনের মধ্যে দিদিই বড় । বড় আদর যত্নে মানুষ হয়েছে দিদি । অনেক চেষ্টা করেও বাবা ওকে লেখাপড়া শিখাতে পারেনি। ওই লম্পট লোকটা কোনদিন চায় নি দিদি পড়াশুনা করুক । তাই প্রেমের ফাঁদে ফেলে একদিন সবার অজান্তে ওকে নিয়ে পালিয়ে যায় । আর কখনও খুঁজে পাওয়া যায় নি । যদিও আমাদের বাড়ি থেকেও চেষ্টা করে নি ।
এখন দিদিকে জঙ্গলের শাল পাতার থালা বানিয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে একমাত্র মেয়ে হাতে তৈরী পাতার ফুল বিক্রি করছে। জোটেনি কোনদিন স্কুলে যাওয়া । এটাই হয়তোবা নিয়তি । কিন্তু ওই ছোট্ট মেয়েটির কি অপরাধ ? ও তো জীবনে কিছুই পেল না ।
(১২)
আমার অফিসের দুদিনের ছুটি শেষ । থাকার জো নেই। চলে যেতে হবে। বেলা বারোটার সময় ট্রেন । দিদি জানালো আমাদের কোন সাহায্য সহযোগিতা সে গ্রহন করবে না । আমাকে দিব্যি দিল আমি যেন কাউকে তার কথা না বলি ।
যাবার বেলায় সরস্বতী আমাকে একটা ফুল দিয়ে বললো, ---+"মামা, দেখ টো কেমন হয়েছে?
---আমি বানিয়েছি । সামনে জয়চন্ডী পাহাড়ের মেলায় খুব বিক্রি হবে রে"
আমি বললাম,
-------"না তোকে আর এই কাজ করতে হবে না । আমি তো কে কলকাতায় নিয়ে যাবো, স্কুলে ভর্তি করবো ।"
সরস্বতী আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
----"কোলকাতা কত দূরে মামা??"
-----"সে অনেক দূর"
"হ্যাঁ মায়ের মুখে শুনেছি বটে।"
(১৩)
আমাদের সাথে দিদি ও সরস্বতী পুরুলিয়া স্টেশন পর্যন্ত এসেছিল। দিদি কে প্রনাম করলাম আর বললাম
-----"আমি তোকে নিয়ে যাবই ।
দিদি অঝোরে কেঁদে উঠলো। আমি ট্রেনে উঠলাম । ট্রেন চলতে সুরু করলো দূর থেকে দেখলাম দিদি সরস্বতীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আমি সরস্বতীর দেয়া পাতার ফুলটি বুকে চেপে একরাশ অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে বসে পড়লাম। মনে হলো অযোধ্যা পাহাড়ের প্রতিটি পাথর, প্রতিটি বৃক্ষের শাখা প্রশাখারা আমাকে দেখে হাসছে । মনে হলো আমার নিস্প্রাণ দেহটা কলকাতা যাচ্ছে কিন্তু আমার আত্মা ওই সাঁওতাল পাড়ার পর্ণ কুটিরে রয়ে গেছে। যেতে যেতে সরস্বতীর ওই সহজ সরল মায়াবী মুখ টা ভাবতে ভাবতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম।
দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। বিল দিয়ে ঘুরতেই দেখি পাশের ইলেকট্রিসিটি পোলটার গায়ে কি একটা লিফলেট লাগানো। উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে গেলাম। সাদা কাগজে লাল কালি দিয়ে বড় বড় করে লেখা, "আমি ১০০০ টাকার একটা নোট এখানে হারিয়ে ফেলেছি। যদি কেউ খুঁজে পান দয়া করে আমার কাছে পৌঁছে দিন। আমি একজন বৃদ্ধ মহিলা, চোখে খুব কম দেখি।" তারপর নিচে একটি ঠিকানা দেওয়া।
ঠিকানা কাছেই। হাঁটা পথে মিনিট পাঁচেক। কৌতূহল দমন করতে না পেরে আমি খুঁজতে খুঁজতে গেলাম সেখানে।
জং ধরা ভাঙাচোরা গেট দিয়ে সাবধানে ভেতরে ঢুকলাম। একটি জরাজীর্ণ টিনের ঘর, উঠানে এক অশীতিপর বৃদ্ধা বসে আছেন।
আমার পায়ের শব্দে পেয়ে তিনি মুখ তুলে তাকালেন, "কে?"
আমার সম্বিত ফিরল, "গলির মাথায় আমি আপনার ১০০০ টাকা খুঁজে পেয়েছি!"
আমার কথা শুনে তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। একটু পর, কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললেন, "বাবা, এই পর্যন্ত অন্তত ১০/১২ জন আমার কাছে এসেছে আর ১০০০ টাকা করে দিয়ে বলেছে, তারা নাকি রাস্তায় আমার টাকা খুঁজে পেয়েছে। আমার কোনো টাকা হারায় নাই, ওই লেখাগুলোও আমার না, আমি খুব একটা পড়ালেখা জানিও না!"
আমি নিচু হয়ে ওনার হাত ধরে বললাম, "যাই হোক, সন্তান মনে করে আপনি টাকাটা রেখে দিন।"
এই কথা শোনার পর তিনি টাকাটা নিয়ে বললেন, "বাবা, আমি খুব অসুস্থ। ভালো করে হাঁটতে চলতে পারি না। কি যে তোমায় খেতে দিই!"
এই বলে তিনি অনেক কষ্টে লাঠিতে ভর দিয়ে বারান্দায় উঠলেন, আমার মনে হলো তিনি এখনি পড়ে যাবেন। আমি তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গেলাম।
তিনি কম্পমান হাতে বাটিতে গুড়মুড়ি ঢালতে বললেন, "তুমি আমার অতিথি! তুমি বসো।"
আমার পেটে একটুও ক্ষুধা ছিল না। তবুও, কিছুটা বৃদ্ধার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে, বাকিটা তার সাথে আরো খানিকক্ষণ গল্প করার লোভে ধীরে ধীরে গুড়মুড়ি খেতে লাগলাম।
কথায় কথায় জানলাম এই পৃথিবীতে আপনজন বলতে ওনার কেউ নেই। আগে ভিক্ষা করতেন, অসুস্থ হবার পর আর বাড়ি থেকে বেরোতে পারেন না।
ফেরার সময় বৃদ্ধা বললেন, "বাবা, একটা অনুরোধ, তুমি যাওয়ার সময় ওই কাগজটা ছিঁড়ে ফেলো।"
আমি ওনার বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মনে মনে ভাবছিলাম, "সবাইকে উনি বলার পরও কেউ কেন কাগজটি ছেঁড়েনি?"
আর ভাবছিলাম ওই মানুষটির কথা যিনি ওই নোটটি লিখেছেন। সহায়সম্বলহীন অসুস্থ বৃদ্ধ মানুষটাকে সাহায্য করার জন্য এত সুন্দর উপায় বের করার জন্য আমি তাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম।
হঠাৎ ভাবনায় ছেদ পড়ল একজনের কথায়, "এই যে, শুনছেন?"
চল্লিশোর্ধ্ব এক ভদ্রলোক আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, "এই ঠিকানাটা কোথায় বলতে পারেন? একটু আগে আমি রাস্তায় ১০০০ টাকার একটা নোট পেয়েছি, এটা আমি ফেরত দিতে চাই।"
ঠিকানা দেখিয়ে সামনে এগোলাম। কখন জানি আমার চোখদুটো ভিজে উঠেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি বিড়বিড় করে বললাম, এভাবেই বেঁচে থাকুক আমাদের মানবতা!
বাবা ভালোবাসতেন বলে ছোট থেকেই মহাভারতের প্রতি অনুরাগ এসেছিল দ্রোণের। বাবার কাছেই ছোটবেলায় পেয়েছিল প্রাথমিক পাঠ। তার যখন পনের বছর বয়স, তখন মা মারা গেলেন, আর বয়স কুড়ি হতে-না-হতেই বাবাও মারা গেলেন। যে হেতু বাবা সেনাবাহিনীতে ছিলেন, পড়াশোনা খাওয়াদাওয়ার অভাব ছিল না, কলকাতার সমস্ত জমিজমা বিক্রি করে পাকাপাকি দার্জিলিং এর বাসিন্দা হয়ে গেল।
ট্রেনে এইসব আলাপের পর দ্রোণ ঘুমিয়ে পড়লে, তার এই ইতিহাস আমি লিখতে শুরু করেছিলাম, লেখা আমার নেশা, বেশ কয়েকটি কবিতার বই প্রকাশের পর মনে হলো গোয়েন্দা গল্প লিখবো, কিন্তু কিছুতেই শুরু করতে পারছিলাম না। বিশেষ করে কোনো প্রাইভেট গোয়েন্দা, এই যেমন শার্লক হোমস্ ফেলুদা, দীপক চ্যাটার্জী, কর্ণেল, ব্যোমকেশ বক্সী, এর প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ, আমাকে লিখতে বাধ্য করত। দ্রোণের মত একটা চরিত্র আমার দরকার ছিল। বাংলা, হিন্দি, উর্দু, তামিল, তেলেগুসহ প্রায় সমস্ত ভারতীয় ভাষায় সে পারদর্শী।
কলকাতায় এসে দ্রোণাচার্য যোগ দিলো নিউ থিয়েটারস স্টুডিও-তে। সেখানে তখন মাস মাইনেতে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়োগ করা হত। এখানে লাইটম্যানের কাজে নিযুক্ত হলো। শখের গোয়েন্দাগিরি তার কপালে সইলো না, বাবার সঙ্গে লক্ষ্ণৌতে কথা কাটাকাটি করে, চলে আসে কলকাতায়।
Comments
Post a Comment