নজরুলের প্রমীলা ।

নজরুলের প্রমীলা ।
.
কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যের পিছনে এক অনন্য অনুপ্রেরণাদায়ী নজরুলের  স্ত্রী প্রমীলা দেবী।  নজরুল যদি কোন নারীকে সবচেয়ে বেশী ভালোবেসে থাকেন তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী প্রমীলা দেবীকে। 
.
প্রমীলা দেবীর আসল নাম ছিলো আশালতা সেনগুপ্ত। ডাকনাম দোলনা। তবে আদর করে অনেকে ডাকতেন দুলি নামে। 
.
প্রমীলা দেবী ছিলেন তাঁর বাবার  দ্বিতীয় স্ত্রীর একমাত্র সন্তান। বাবাকে হারিয়েছিলেন শৈশবেই। কাকার সংসারে বেড়ে উঠা তাঁর। 

কুমিল্লায় যখন রাজনৈতিক মিছিল বেরিয়েছে, তখন কিশোরী দুলি তাতেও অংশ নিয়েছেন বলে জানা যায়।
সেই সময় এক চৈত্র মাসের শেষে কান্দিরপাড়ের সেই বাড়িতেই এসেছিলেন নজরুল। 

মাত্র কদিনের জন্য এসেছিলেন নজরুল কিন্তু সেই কদিন বাড়ির হাওয়ায় ঝড় তুলে তিনি আবার ঝড়ের গতিতেই চলে গেলেন দৌলতপুর নামে এক গ্রামে।

সেখান থেকে দেড় মাস পরেই খবর এল, নুরুদার বিয়ে।  বাড়ির অন্যদের সঙ্গে প্রমীলা ও গিয়েছিলেন। 
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সেই রাতেই বিয়েটা হতে হতে ভেঙে গেল। তার পরই নুরুদা আর প্রমীলার চাচাতো ভাই বীরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত আষাঢ়ের সেই জোছনারাতে কান্দিরপাড়ে চলে যান। পরের দিন প্রমীলাও ফিরে আসেন।
.
এই দুর্ঘটনার প্রচণ্ড আঘাতে নুরুদা মুষড়ে পড়েন। কিন্তু সপ্তাহ তিনেক পর কলকাতা থেকে আসা এক বন্ধুর সঙ্গে নজরুল কলকাতায় ফিরে যান। তবে মাস তিনেক পর, অক্টোবর মাসে, নজরুল আবার কান্দিরপাড়ে বেড়াতে আসেন। সেবারে পাঁচ-ছয় সপ্তাহ ছিলেন।
.
তারপর  প্রমীলাদের বাড়িতে নজরুল এসেছিলেন 
পরের বছর মাসে ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। 
নজরুল একদিন তাঁকে একটা কবিতা উপহার দিলেন, যার প্রথম পঙ্‌ক্তিতেই আছে—‘হে মোর রানী, তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।’ এ কথার মানে দুলি বোঝেন, আবার বোঝেন না। এ কি তাঁকেই বলা? সেবার এসে নজরুল কান্দিরপাড়ে ছিলেন প্রায় চার মাস। শেষ দিকে তাই নিয়ে রক্ষণশীল হিন্দুরা কুৎসা রটাতে আরম্ভ করেন, তাঁকে অপমান করতে উদ্যত হয়েছিলেন। ওদিকে কলকাতা থেকেও কাজের ডাক আসে। তাই মে মাসের শেষে নজরুল কলকাতায় ফিরে যান। 
.
১৯২২ সালের  নভেম্বর মাসে নজরুল এবং  প্রমীলার দেখা হয়  বিহারের সমস্তিপুরে, প্রমীলার মামার বাড়িতে। নজরুলের কাছ থেকে প্রমীলা শুনলেন, তাঁর পেছনে পুলিশ লেগেছে। প্রমীলার হৃদয় আশঙ্কায় দুলে ওঠে। নজরুল তাঁদের সমস্তিপুর থেকে কান্দিরপাড়ে পৌঁছে দিলেন। কিন্তু সেখানে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কবিতায় কী একটা কথা লেখার অভিযোগে নুরুদা গ্রেপ্তার হলেন পুলিশের হাতে। মামলা হলো, মামলায় তাঁর সাজা হলো এক বছরের। 
.
জেল থেকে ছাড়া পেলেন ১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে।
তার তিন-চার দিনের মধ্যেই প্রমীলার মিলন হলো। 
কিন্তু কদিন পরই নজরুলের আরেকটা মামলা ছিল। তাই কান্দিরপাড়ে বেশি দিন থাকা সম্ভব হলো না। তা ছাড়া বর্ণ হিন্দুরা ঝামেলা করছিলো। তাই প্রমীলা  আর তাঁর মাকে সমস্তিপুরে পৌঁছে দিয়ে নজরুল কলকাতায় চলে যান।

নজরুল এবং প্রমীলার  বিয়ে হয়  ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল।  এবারও সমস্তিপুর থেকে দুলি আর তাঁর মাকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন নজরুল। নজরুল স্ত্রীর দোলনা  নাম পাল্টে রাখলেন প্রমীলা। 
.
বিয়ের আগে প্রমীলাকে পার হতে হয়েছিল দুস্তর সমুদ্র। প্রথমেই ছাড়তে হয়েছিল তাঁর পরিবারকে, যে পরিবারের আশ্রয়ে তিনি বড় হচ্ছিলেন, যে পরিবারের লোকেরা ছিলেন তাঁর একমাত্র আপনজন। তা ছাড়া প্রবল বাধা এসেছিল সমাজের তরফ থেকে। কারণ, হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে বিয়ে হয় না। তখনকার একাধিক রাজনীতিক এ বিয়ের প্রতি তাঁদের সমর্থন জানিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও বেশ গোপনীয়তা অবলম্বন করে মুসলমান-অধ্যুষিত সড়কের এক বাড়িতে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। বিয়ে হতে আইনের বাধাও কম ছিল না। বাধা থাকত না যদি প্রমীলা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতেন অথবা তাঁর বয়স অন্তত আঠারো হতো। কিন্তু তাঁর বয়স ছিল ষোলো বছরেরও সপ্তাহ দুয়েক কম। তিনি মুসলমান হতে চাননি, নাকি তাঁর মা গিরিবালা দেবী তা চাননি, নাকি নজরুলই তা চাননি—জানা যায় না। কিন্তু আইনের বাধাকে গোঁজামিল দিয়ে অতিক্রম করেন নজরুল ও তাঁর বন্ধুরা। শেষ পর্যন্ত তাঁদের বিয়ে হয় ইসলামি রীতি অনুযায়ী। নজরুলের বেশির ভাগ বন্ধুই ছিলেন হিন্দু। কিন্তু বিয়েতে তাঁদের একজনও উপস্থিত ছিলেন না।
বিয়েতে ধুমধাম করার মতো টাকাপয়সা নজরুলের ছিল না। বিয়ে হয়েছিল মাসুদা রহমান নামের এক বিশিষ্ট নারীর সার্বিক আনুকূল্যে। বিয়ের সঙ্গে যুক্ত আনন্দ-উৎসবও বলতে গেলে কিছুমাত্র ছিল না। সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দেয় বিয়ের পর। ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে বিখ্যাত হলে কী হবে—মুসলমান নামধারী নজরুলের পক্ষে বাড়ি ভাড়া পাওয়া প্রায় অসম্ভব হলো। আর প্রমীলা ও গিরিবালা দেবী পড়লেন নিজেদের স্বরূপের সংকটে। তাঁরা না মেশার সুযোগ পাচ্ছিলেন হিন্দু পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে, না পারছিলেন মুসলমানদের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে মিশতে।
.
সংসারের মধ্যে থেকেই তাঁরা একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। এই নিঃসঙ্গতা আংশিকভাবে তাঁরা কাটিয়ে উঠতে পারতেন নজরুল যদি ঘরমুখী হতেন। কিন্তু তিনি বেশির ভাগ সময়ই থাকতেন ঘরের বাইরে। তাঁর জগৎটা ছিল সংসার থেকে অনেক দূরে—বন্ধুদের মধ্যে। তাঁর সময় কাটত আড্ডা দিয়ে, গান গেয়ে, হইচই করে। তাঁর ধারণা ছিল ‘বেলা যাবে এবে (গান গেয়ে আর) পান খেয়ে।’ স্ত্রীকে সঙ্গ দেবার মতো অফুরন্ত সময় কোথায় তাঁর?
.
শেষ জীবনে পক্ষঘাতগ্রস্থ হয়েছিলেন প্রমীলা দেবী।  রোগ সারানোর জন্য কবি নজরুল কোনো চিকিৎসাই বাদ রাখেননি। প্রমীলার প্রতি নজরুলের কতটা দরদ ও প্রেম ছিল সে সম্পর্কে অনেক নজরুল গবেষকও অবগত নন। দেব-দেবী, ভূত-প্রেত, সাধু-সন্ন্যাসীর মন্দির, পীর-ফকির, তাবিজ-কবজ, মাবার, পানিপড়া এসব নিয়েও কবি প্রমীলাকে সারিয়ে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকেন। 
.
কবি জসীম উদদীনের বিবরণী থেকে জানা যায় কোন এক দরবেশের পরামর্শে নজরুল শত বছরের কচুরী পানাভর্তি এক পচাডোবায় সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত শরীর নিমজ্জিত রেখে অতঃপর দরবেশের তাবিজ নিয়ে প্রমীলাকে দিয়েছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। 
.
প্রমীলা দেবীও ঐ অসুস্থ অবস্থার মধ্যেও যতদিন পেরেছেন, ঐ অচল অবস্থাতেও তিনি নিজ হাতে স্বামীকে খাইয়ে দিয়েছেন। কবির ভক্ত ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে তিনি একান্ত আপনজনের মতো ব্যবহার করতেন।
.
১৯৬২ সালের ৩০ জুন মারা যান প্রমীলা।  তাঁকে কবর দেয়া হয়  চুরুলিয়ায় নজরুলের পৈতৃক বাড়িতে। তাঁর ইচ্ছা অনুসারে তাঁর কবরের পাশে জায়গাও  রাখা হয়েছিলো নজরুলের জন্য। । কিন্তু তাঁর শেষ ইচ্ছেটা পূরণ হয়নি। 
.
ছবি - অসুস্থ স্ত্রী প্রমীলা দেবীর পাশে কাজী নজরুল ইসলাম ।

তথ্য সূত্র-  প্রমীলার প্রতীক্ষা/ গোলাম মুরশিদ
সৌজন্যে: বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র (ইশতিয়াক)

#ইতিহাসেরখোঁজেগিরিধর
#গিরিধরদে

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ