আধুনিকতা [শ্রুতি নাটিকা]

শ্রুতি নাটিকা 


চরিত্রলিপি


মা

খোকা

বৌমা

নাতনি


মা-- খোকা,খোকা তুই যাস না খোকা,কেন রাগ করিস? খেয়ে যা, কেন এত অশান্তি করিস? আমাকে নিয়ে তোদের এত সমস্যা কেন? বাবা তোর কাছে আমাকে রাখতে হবে না, বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আয়। বৌমাকে বল আমি চলে যাবো।


বৌমা--আপনি চলে যাবেন,কেন মা? আপনার বাড়ি,আপনার ছেলে,সবই তো আপনার আমার কি আছে? আমি তো পরের বাড়ির মেয়ে,আমিই নয় বাপের বাড়ি চলে যাই।


খোকা--তা তো যাবেই, সুবিধা হবে তো,সারাদিন ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কাটাতে পারবে। মিথ্যে বলে এখানে ওখানে যেতে পারবে। রাত কাটাতেও পারবে।


বৌমা --হ্যাঁ,তাই কাটাব,কি দিয়েছ এই ১৮ বছরে? দিনের পর দিন যখন দেখি অন্যের ঘরের বউরা দামি দামি শাড়ি পরছে,পার্লারে যাচ্ছে, নতুন নতুন শাড়ি পরে স্কুলে বাচ্ছা দিতে আসছে, আমার ও ইচ্ছে হয়,দামি দামি শাড়ি পরি,সেই এক শাড়ি এক কুর্তি,বিউটি পার্লার তো বছরে একবার দেখি কিনা সন্দেহ আছে, রান্নাঘর আর বাচ্ছা ছাড়া আর কি দিয়েছ।


খোকা--আর কি দেবো? নষ্টামো করার জন্য বয় ফ্রেন্ড? ভিডিও কল করার জন্য মোবাইল তো কিনে দিয়েছি। গত এক বছর ধরে যে বন্ধু প্রীতি চলছে,সেটাও তো আমার দেওয়া,শুধু বন্ধু প্রীতি কেন? বন্ধুর বর প্রীতি ও তো চলছে,বাথরুমে চিলেকোঠায়।


বৌমা--বেশ করেছি,তুমি কি ধোয়া তুলসী পাতা?

কচি খোকা? যাও না মায়ের কোলে বসে পড়ো, ভালোই লাগবে মায়ের, অনেক দিনতো হলো। সোহাগ? বুঝি না? জ্বালাটা কোথায়?


মা--একি বললে বৌমা,কি ইঙ্গিত করতে চাইছো তুমি? ছিঃ ছিঃ বৌমা,তুমি না শিক্ষিত মহিলা, আমরা তো অশিক্ষিত মূর্খ, তোমার মুখে এ সব মানায় না। মা ছেলের সম্পর্ক পৃথিবীর সব থেকে পবিত্র সম্পর্ক। তাকে তুমি অপবিত্র করে দিও না বৌমা।


বৌমা-- থামুন তো, ওসব জানা আছে, জ্বালা, শুধু জ্বালা তাই না? আমি জানি না? ছেলে অফিস থেকে ফিরলে তার কান কে ভরে? সারাদিন কি করি না করি,আপনার ছেলে তো কামেরা লাগিয়ে রাখেনি? যে অফিস থেকে ফিরলেই সব দেখতে পাবে। বাড়িতে ঝামেলার এক মাত্র কারণ আপনি।


মা--বৌমা ! 


খোকা- -চুপ করো তুমি। খুব বেড়েছ তাই না? খুব মুখ বেড়েছে, এই শেখাচ্ছে তোমার বন্ধুরা। স্কুলটাই কাল হলো, কতগুলো বাজে ধরনের মহিলা তোমার মাথাটা খাচ্ছে,তারা জয়েন্ট ফ্যামিলিটা চেনে না। সারাদিন শাশুড়ি নিন্দা। 


বৌমা-- একদম ওদের নামে কিছু বলবে না, ওরা তোমার খেতে আসে না।


খোকা--খেতে না এলেও খাওয়ার লোক তৈরী করে দিচ্ছে যে। 


বৌমা--একদম বাজে কথা বলবে না।


খোকা-- বাবা কত দরদ, যে বউ গুলোর সাথে মেশো তাদের কোন বউটা তার শাশুড়ির সঙ্গে থাকে? সব তার শাশুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়েছে, তুমিও চাইছো আমিও তাই করি? ভুল ভেবেছ।


বৌমা-- তা করবে কেন? তাহলে তো বউ সারাদিন কি করে খবর পাবে না। মায়ের প্রতি এত দরদ কেন জানি না? সোহাগ? অফিস থেকে ফিরেই, মায়ের ঘরে, ( ভেঙিয়ে) মা, কি খেয়েছ? হাঁটুর ব্যথা ঠিক আছে তো? বুঝি না, পায়ে তেল মাখাতে মাখাতে যত কূটনীতি করা।


খোকা--বেশ করেছি, আমার মা, আমাকে করতেই হবে। আর কে আছে মায়ের?


বৌমা--আমি করিনি মনে হয়? হাসপাতাল থেকে আসার পর কে দেখেছিল তিনমাস? খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে,নোঙরা কাপড় কে ধুয়ে দিতো?


মা--তুমি বৌমা, তোমরা ছাড়া আমার কে আছে মা?


বৌমা--কেন? ভায়ের বউ? সেতো নিয়ে যেতে পারত, একদিন ও এসে করতে পারত, আপনার শুশ্রূষা। বেইমান, এত করার পরেও আমার নামে লাগানি ভাঙ্গানি করতে আপনার লজ্জা হয়নি? আজকের কথাই ধরুন, আপনি যদি কিছু না বলতেন,তাহলে তো ঝগড়া লাগত না?


মা--আমি কিছু বলিনি বৌমা, এরকম আমি শিখিনি বৌমা, যে সব সময় বাড়ির লোকের নামে বলব।


বৌমা--না বলেননি, মিথ্যেবাদী -ছোটলোক। অনেকদিন তো বাঁচলেন, এবার তো মরতে পারেন।


খোকা--সাবধান,আর একটা কথা বললে,-

বৌমা--কি করবে? মারবে নাকি? গায়ে হাত দিয়ে দেখো না, কি করে জব্দ করতে হয়,আমি জানি।

বধু নির্যাতনের কেশে ফেলে জেলের ঘানি টানাব।


খোকা--কি বললে? জব্দ করবে? তাই? এত সাহস হয়েছে তোমার,এত বড় কথা,দিনের পর দিন,ওই নাতাসার বাড়িতে কিসের আড্ডা? কেন ওদের বাড়িতে মেয়ের পড়ার নাম করে,দুপুর বেলায় পড়ে থাকো? বুঝি না ভেবেছ?  


মা-- কি সব বলছিস খোকা,চুপ কর না।


বৌমা--এখন বলে কি হবে, যা করার তো করেই দিয়েছেন, কূটনি বুড়ি কোথাকার। লাগানি ভাঙ্গানি করে আমার সংসারটা ভেঙ্গে দিলেন। ( কাঁদে )


মা--কি বলছ বৌমা?আমি তোমার সংসার ভেঙে দেবো? আমার ছেলের সংসার? হা ভগবান এ সব শোনার আগে আমার মৃত্যু কেন হলো না? এরকম করে বলো না বৌমা,তোমার বাড়িতেও মা আছে,


বৌমা--ঠিক বলছি,আর আমার মা এত লাগানি ভাঙানি জানে না,আপনার মতো। দেখুন গিয়ে আমার মা কত শান্তিতে আছে,ছেলের বউ নিয়ে।কেউ কারো সাথে পাঁচে থাকে না। 


মা--আমি কি থাকি বৌমা? আমিতো কোনদিন তোমার কোন কিছুতে বাধা দেইনি,তুমিই বরং আমার নাম করে,খোকাকে নানান কথা বলো।


বৌমা-- হ্যাঁ এখন তো তাই বলবেন,আপনার খোকা তো আছে,জিগেস করুন?কোনদিন-


খোকা-তুমি আর উত্তেজিত হয়ো না প্রেসার বেড়ে যাবে। একে তো নানা রোগে ভুগছ,এবারে ওটাও ধরে নেবে,


বৌমা--হ্যাঁ তাতো বলবেই,যেন আমি বাপির বাড়ি থেকে রোগ গুলো এনেছি,আঠার বছর ধরে শুধু নিগড়ে নিয়েছ তোমরা,সারাদিন সংসার টানতে টানতে আমার শরীর টাই শেষ হয়ে গেল। কি সুন্দর চেহারা ছিল আমার,আর কি হয়েছে? কই একবার তো বলো না,চলো ভালো ডাক্তার দেখিয়ে আনি, শুধু মার কি হলো? মার কি হলো,মাসে চার হাজার টাকার ওষুধতো মায়ের পেটেই চলে যায়, তাহলে মায়ের জন্য চার হাজার টাকার এক্সট্রা ওষুধ কিনতে পারো আর আমার জন্য চার হাজার টাকার শাড়ি গয়না কিনলে,সংসার চলে না? বাড়িতে একটা কাজের লোক নেই, বাসন মাজা কাপড় কাচা সব করি,কই তার জন্য আমাকে টাকা দাও নাতো কই? সব মা-


খোকা--বাড়ির বউদের সব করতে হয়,


বৌমা--হ্যাঁ তাতো বটেই, বিনে পয়সায় কাজের লোক কোথায় পাবে? তাই দুমুঠো খেতে পাই, আর ওই বুড়িটা আমার নামে -


নাতনি-- চুপ করো মা, অনেকখন ধরে তোমার ডায়লগ শুনছি, কি করো তুমি, সকাল বেলা বাসন বাপি মেজে দেয়, ঠাম্মি ঘর মুছে দেয়, আর কি করে দেবে, শুধুতো রান্নাটাই করো, 


বৌমা--আর বুঝি কিছু কাজ নেই,তুই খুব বড় হয়েছিস তাই না? বড়দের মধ্যে কথা বলিস? বংশ,যেমন বাপ তেমন মেয়ে-


নাতনি--হ্যাঁ তাই- সারাদিন যে ফোনে এত কথা বলো, কোনোদিন খোঁজ নিয়েছ ঠাম্মি মরল না বাঁচল, বাপি এসে ঠাম্মির কাছে গেলেই দোষ, যতক্ষন বাপি বাড়িতে থাকবে তিষ্টোতে দাও না বাপিকে,  অফিসের রান্নাটাও সময়ে হয় না,

সারাদিন ফোনে গল্প, অনেক সময় তো ভুলেই যাও কি বসিয়েছ রান্না,

বৌমা--খুব তো বড় বড় কথা বলছিস কই, নিজেতো করিস না? স্নান করে জামাটাও ধুস না।

নাতনি--যখন করার হবে নিশ্চয়ই করব,দেখো মা এসব অশান্তি অনেক হয়েছে এবার বন্ধ করো-আর শোনো মা ঠাম্মি কিছু বলে না, আমি বলেছি বাপিকে, তুমি যেভাবে ওদের সাথে গল্প জুড়ে দাও। তোমার মনেই থাকে না আমার লেখাপড়া আছে,সারাদিন শুধু পরনিন্দা পরচর্চা। এর জন্য আমার গত বছরের রেজাল্ট ও খারাপ হয়েছে। 


বৌমা--ও তাই?লায়েক হয়েছিস তাই না,খুব কথা শিখেছিস, আমি ই তোকে ভালো স্কুলে ভর্তি করেছি,নইলে এই পাড়ার ছাতুর স্কুলে পড়তে হতো। 


নাতনি--ভালোই হতো মা, তাহলে আর তোমাকে এ ভাবে হারিয়ে যেতে হতো না,এই আধুনিকতার ভিড়ে। 


Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ