নাটক।। দুপুরবেলাা।।
দুপুরবেলা
দেবপ্রসাদ জানা
কুশীলব
বাছান সমাদ্দার
পরাণ নন্দী
বিশ্বজিৎ মহান্তী
[নতুন নেতার আগমনে স্থানীয় কর্মীদের অভ্যন্তরে
তার প্রভাব ]
বিশ্ব- নন্দীদা, দাঁড়িয়ে কি করছ ? দাদা আসছেন।
নন্দী-(চমকিয়ে মুখ ফেরাল) হুঁ,আসছে, আসছে তো আমি কি করব? কালকের ছোকরা,চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিত,বাপে ঘরে ঢুকতে দেয় না। পাশের বাড়ির বৌদির সাথে দুপুরে ফস্টিনস্টি করত,এখন জেলখাটার ভয়ে,পাটির ঝান্ডা ধরে ঘুরে বেড়িয়ে নেতা হয়েছে।
বিশ্ব- ওসব বলে আর কি হবে? সিন্ডিকেটের নেতা। দলের আয় বাড়াতে আসছে, আর আমাদের পিন্ডি চটকাতে।
নন্দী- (বিকৃত-স্বরে) আসছেন ত আমি করব কি? খবর নেই, এত্তালা নেই—দাদা আসছেন। দাদা বলে ত আর মাথা কেটে নিতে পারবে না!
বিশ্ব- ( উত্তেজনার বসে) আরে, তুমি কি মরিয়া হয়ে গেলে নাকি?
নন্দী - মরিয়া কিসের! পাঁচ বছর পেয়েছে। এর বেশীতো কিছু না! তুই জানিস বিশু, কালীবাবু ওকে দূর করে দিয়েছিল, পাটি অফিসে ঢুকতে পর্যন্ত দিত না। সমস্ত ঠিকঠাক ছিল মেম্বার সিপ ক্যানসেল করার আগেই হঠাৎ খামকা মরে গেল। বলেই ত আজ নেতা ! নইলে আজ কোথায় থাকতো ? আমি জানি না?
বিশ্ব- কিন্তু জেনে সুবিধেটা কি হচ্ছে ? এ তো কালীবাবু নয়। সব কথা শুনবে? ওর কানে গেলে তোমার ঘরে সন্ধ্যে দিতেও কাউকে বাকি রাখবে না। ধরবে আর দুম করে গুলি করে মারবে। এমন কত গণ্ডা এরই মধ্যে মেরে পুঁতে ফেলেছে জানো? ভয়ে কেউ কথাটি পর্যন্ত বলে না।
নন্দী- হাঁ:—কথা কয় না! মগের মুল্লুক নাকি?
বিশ্ব-আরে মাতাল যে! সন্ধের পর আর হুঁশ জ্ঞান থাকে না। দয়া-মায়া আছে বলেও মনে হয় না।বন্দুক-পিস্তল-ছুরি-ছোরা ছাড়া এক পাও কোথাও ফেলে না। মেরে ফেললে তখন করবে কি শুনি?
নন্দী- তুই ত সেদিন সদর অফিসে গেছিলি—দেখেছিস ওকে?
বিশ্ব- না, ঠিক দেখিনি, তবে সে না দেখাই ভালো ছিল। ইয়া গোলপাট্টা, ইয়া বড় গোঁফ, ইয়া বুকের ছাতি, জবাফুলের মত লাল চোখ,
নন্দী- বিশু, তবে চল পালাই।
বিশ্ব- আরে পালিয়ে ক'দিন তার কাছে বাঁচবে নন্দীবাবু? চুলের ঝুঁটি ধরে টেনে এনে কবর খুঁড়ে পুঁতে ফেলবে।
নন্দী - কি হবে তাহলে? মাতালটা যদি বলে বসে, অমৃতবিন্দু ভবনে থাকব?
বিশ্ব- কতবার ত বলেছি নন্দীবাবু, এ কাজ করো না, করো না, করো না। শুনেছিলে আমার কথা?বছরের পর বছর খাতায় কেবল মিথ্যে মেরামতি খরচ লিখে গেলে, গরীবের কথায় ত আর কান দিলে না। এখন পার্টি বদলেছে, লোক বদলেছে, নিজে নিজের ফয়দার কথা তারাও ভাবছে, আমাদের মতো। জানো পাড়ায় বাড়ি করলে সিন্ডিকের থেকে মালমশলা নিতে হবে,নইলে বাড়ি হবে না, ভাঙ্গা ইট পাথর বালি রাস্তা দিয়ে যেতে দেবে না।
নন্দী- কেন?
বিশ্ব-কেন কি? নতুন রাস্তা, ঢালাই ভেঙ্গে যাবে না? গাড়ির ভারে,
নন্দী- তুইও তো পঞ্চায়েতের বড় কন্টাক্টর, তুইও তো কম ইনকাম করিস নি? সেটার বেলা?
বিশ্ব- দেখ, ও-সব শয়তানি ফন্দি করো না ! আমার ওপর দোষ চাপাছ? —ওই যে একটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে
[নেপথ্যে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। পরাণ নন্দী পালানোর চেষ্টা করলে, বিশ্ব হাতটা ধরে ফেলিতেই সে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল]
নন্দী- ছাড়্না শয়তানের বাচ্ছা
বিশ্ব- (অনুচ্চ চাপাকণ্ঠে) পালাচ্ছো কোথায়? ধরলে গুলি করে মারবে যে!
[ বাছানদার প্রবেশ, গোলগাল। মাঝ বয়সি, চোখদুটো ফোলা ফোলা লাল, জিজ্ঞাসা করলেন]
বাছান-ওহে, এ গ্রামে পঞ্চায়েতের বাড়িটা কোথায় তোমরা কেউ বলে দিতে পার?
নন্দী-(করজোড়ে) সমস্তই ত দাদার -রাজ্য
বাছান-রাজ্যের খবর জানতে চাইনি। পঞ্চায়েত টা কোথায়?
নন্দী- জানি স্যর। ওই যে।
বাছান- তুমি কে?
[নন্দী ও বিশ্ব উভয়ে ভূমিষ্ঠ প্রণাম করে উঠে দাঁড়াল]
নন্দী- স্যরের একনিষ্ট পরাণ নন্দী।
বাছান-ওহো, তুমিই পরাণ নন্দী —অমৃতবিন্দুর বড় সাহেব? কিন্তু দেখ নন্দী, একটা কথা বলে রাখি তোমাকে। মোসাহেব অপছন্দ করি না সত্যি, কিন্তু তার একটা লিমিট থাকাটাও পছন্দ করি! এটা ভুলো না। তোমার অমৃতবিন্দুর ফান্ডে কত মজুত আছে ?
নন্দী- তা, আয় প্রায় হাজার-পঞ্চাশেক হবে প্রতি মাসে,তাওতো বিরো-[ বিশ্ব হাত চেপে ধরে]
বাছান- হাজার-পঞ্চাশেক?—বেশ বেশ।
আমি এখানে দিন দশেক আছি, কিন্তু এরই মধ্যে আমার চার লাখ টাকা চাই, যে নন্দী মহাজন ।
নন্দী-আ- আমি মহাজন নই, পরাণ নন্দী।
বাছান-তুমি সমস্ত প্রমোটারদের খবর দাও যেন কাল তারা এসে অমৃতবিন্দুতে হাজির হয়।
নন্দী-স্যরের আদেশ কেউ অমান্য করবে না।
বাছান-এখানে বিরোধী বলে কেউ আছে নাকি ?
নন্দী- না, তা এমন কেউ—শুধু রজত আর্চায্য- যদিও এই এলাকার লোক নয়।
বাছান- রজত আর্চায্যটা কে?
নন্দী- এই পঞ্চায়েতের প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
বাছান- এই লোকটাই কি বছর-দুই আগে, একটা খুনের মামলায় বড়দার বিপক্ষে সাক্ষী দিয়েছিল?
নন্দী-(মাথা নেড়ে সম্মতি) স্যরের নজর থেকে কিছুই এড়ায় না। হ্যাঁ , এই সেই রজত আর্চায্য।
বাছান- হুঁ। সেবার অনেক টাকার গুনেগার দিতে হয়েছিল বড়দাকে । শুধু স্কুল মাস্টারি করে ? না আরো কিছু আছে?
নন্দী-(মনে মনে হিসাব করে) অজন্তার মোড়ে সত্তর বিঘে জমির ওপর,বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট তৈরী করছে,আরো কয়েক বিঘে জমি রাখা আছে।
বাছান-ওকে তুমি আজই অমৃতবিন্দুতে ডেকে এনে জানিয়ে দাও যে, ফ্লাট প্রতি আমার পঞ্চাশ হাজার টাকা করে চাই।
নন্দী- (সঙ্কুচিত হয়ে) রজত আর্চায্য যেমন তেমন লোক নয় স্যর, বড় বড় আইনজীবিরা ওর পায়ের তলায় থাকে। আর সব সম্পত্তি ওর নিজের সম্পত্তি। কোন কাজ জয়েন্ট ভেঞ্চারে করে না।
বাছান-ও সব আমি বুঝি না। আমার এলাকায় ব্যবসা করতে হলে, এই টাকা দিতেই হবে।
নইলে সব দখল হয়ে যাবে।
নন্দী- আমি আজই তাকে খবর পাঠাচ্ছি।
বাছান-শুধু ওকেই খবর জানালে হবে না, সকলকে জানিয়ে দাও, যারা বড়দার ভালো মানুষির সুযোগে, করে কম্মে খাচ্ছে তারাও যেন টাকাটা দু’দিনের মধ্যে দিয়ে দেয়।
নন্দী-কিন্তু স্যর-
বাছান- কোন কিন্তু নয় পরাণ নন্দী। এই সোজা কাজ টা আজকের মধ্যে হওয়া চাই।
[ প্রস্থান ]
নন্দী- যা ভেবেছি তাই যে হলো রে বিশু! এ যে গিয়ে সোজা অমৃতবিন্দুতেই ঢুকতে চায়।
বিশ্ব- নয় ত কি তোমার পঞ্চায়েত খোঁয়াড়ে গিয়ে ঢুকবে?
নন্দী- সেখানে হয়ত ঢোকবার কোন পথ নেই। হয়তো দরজা-জানালা সব চোরে চুরি করে নিয়ে গেছে, হয়তো ঘরে ঘরে শিয়াল কুকুর বসবাস করছে। —সেখানে কি যে আছে,আর কি যে নেই, কিছুই যে জানি না বিশ্বজিৎ।
বিশ্ব- আমি কি জানি নাকি তোমার দরজা-জানালার খবর? আর শেয়াল কুকুরের কাছে ত আমি কাটমানি আনতে যাইনি?
নন্দী-এই রাত্তিরে কোথায় যাবো?, কোথায় লোকজন, কোথায় খাবার-দাবার—
বিশ্ব-রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদলে লোকজন জুটতে পারে, কিন্তু খাবার-দাবার—জুটবে না।
নন্দী- তোর কি! তুই ত বলবিই রে নচ্ছার পাজী শালা শয়তানের বাচ্ছা।
[প্রস্থান]
Comments
Post a Comment