বিচার চাই ধর্মাবতার

বিচার চাই ধর্মাবতার
দেবপ্রসাদ জানা

একটা সিগারেট ধরালাম। একটা টান দিয়ে ধোঁয়া টা গলার্ধকরণ করে, তাকালাম তার দিকে, রতনের মুখটা বেশ সুন্দর, কালো নয় চাপা রঙ, ভ্রুর কাছটা কাটা দাগ, সেই অংশ ফাঁকা। চোয়াল ভাঙা। গালে কয়েকটা ব্রণর দাগ। থুতনি শক্ত এবং চাপা। নাকের ডগা রীতিমতন চিকণ। মুখে হাসি না থাকলেও হাসি হাসি মুখ। রতনের ফাইলটা খুললাম। 
-তুমি কোথায় থাকো?
-দমদমে।
-তোমার বয়েস? 
-কুড়ি।
-পড়াশোনা কতদূর করেছ?
-বেশি দূর নয়। বারো শুরু করেছিলাম। 
বলেই বুকের কাছের বোতামটা আটকে নিলো রতন,
-তোমার কি ভয় করছে?
আমার প্রশ্নে রতন কেমন থতমত খেয়ে গেল। 
-ভয়?.....না, ভয় নয়। রতন খাপছাড়া ভাবে জবাব দিলো।
-আমার মনে হল, তোমার ভয় ভয় করছে। ঘরে এসি চলছে তাও তুমি ঘামছো। এখন কার্তিক মাসের শেষ। সকালে রাত্রে বেশ ঠান্ডা পড়ছে। এক একদিন ঘন কুয়াশা হচ্ছে। রাত্রে হিম পড়ে। এখন অবশ্য না দিন না রাত। দুপুরের শেষ। তাও তুমি ঘামছো।
এসি বন্ধ করে, জানলার পর্দা সরিয়ে কাঁচের পাল্লাগুলো খুলে দিলাম আলো আসবে, মরা রোদ দেখা যাবে। রতন বলল-
- না না স্যর, এই ঘামকে টেনশান সোয়েটিং বলে। শীত গ্রীষ্ম বলে কথা নেই।
-তুমি গলার দিকে বোতাম এঁটে দিলে-তাই মনে হল, ভয় পাচ্ছো, তুমিতো বেশ কথা বলো, জ্ঞান ও বেশ, অল্প শিক্ষিত হলেও পড়াশোনা ভালোই, 
আমি সিগারেটে আরো একটা টান দিলাম, ধোঁয়া গিলে একবাব ফাইলটার দিকে তাকিলাম, এবার চোখ তুললাম। 'তোমার বাড়ির কথা বলো। 
-কে কে আছেন?'
রতন গলা পরিষ্কার করে বলল। '
-অনেকে আছে। মা বাবা, বোন ভাই বিধবা এক পিসি। 
আমি এবার একটু হাসি হাসি মুখ করলাম।
-কাগজপত্র দেখে যা জেনেছি। তা তোমার বাবাব বয়েস কত?
-কাগজে লেখা নেই? 
রতন যেন অন্য স্বরে বলল, একটু খোঁচা থাকতে পারে।
-যা জিজ্ঞেস করছি বলো। আমার গলা নিজের থেকেই শক্ত হয়ে গেল। রতন চোখ নামাল। '
-বাবার ঠিক বয়েস আমি জানি না স্যর। বছর ছাপান্ন হবে হয়তো।
-এখনও চাকরি করেন?
-হ্যাঁ। হোটেলে। 
-তোমাদের একটা দোকান আছে না?
-না স্যর, দোকান নয়। আমার ভাই একটু জায়গা ঘিরে নিয়ে বসে পান বিড়ি বেচে।
-তোমার মা?
- স্কুলে, পড়াশোনার কাজ নয় স্যর। স্কুলের অফিসে। সামান্য কাজ।
-তোমাদের বাড়ি কোথায়?
- ওই যে রেল লাইনের ধারে কলোনীতে,
- আমি সে বাড়ির কথা বলিনি, দেশের বাড়ি।
আমি রতনের মুখচোখ লক্ষ্য করছিলাম। বাড়ির কথাবার্তা বলতে তার ভালো লাগছিল না।
-বিরক্ত হলি? 
-বিরক্ত হয়ে লাভ নেই, প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে।
সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে নিভিয়ে দিলাম। দেওয়ালের ঘড়িতে তিনটে দশ। বাইরে রোদের তাত কমছে বোধ হয়। বাইরে আকাশ বাতাস মনোরম। 
-তোমাদের দেশ কোথায় জানো না?
-শুনেছি আদিগ্রাম। শোনা-কথার দেশ। দেখিনি কোনদিন।
-তোমরা কি বরাবর কলকাতায়?
-্খাস কলকাতায় নয় স্যর। আমি জন্মেছি কলোনীতে। আমরা অনেক জায়গায় থেকেছি। ভাড়াবাড়িতে, বস্তিতে।
-বস্তিতে?
-আজকাল বস্তিই বেশি। রতনের গলা যেন ঠাট্টার মতন শোনাল। 'বস্তিতেই বেশি লোক থাকে। আমাদের মতন লোক।'
আমি কিছু বললাম না। ওকে অল্পস্বল্প সহজ স্বাভাবিক হওযার সুযোগ দেলাম। বরং আরও একটু বেশি হালকা হতে দিলেও ক্ষতি হবে না।
-তা ঠিক। 
আমি মাথা নাড়লাম, 'কলকাতার দশ আনাই শুনেছি বস্তি হয়ে গিয়েছে। এক একটা  বাড়িতে চার পাঁচটা করে ভাড়াটে। রেললাইনের ধারের কলোনিগুলো সব নরক।'
-লোকে তাই বলে।
আমার চশমাটা টেবিলের উপর রাখা ছিল। চশমার পাশে ডট পেন। ডট পেনটা তুলে, প্যাডের উপর রাখলাম। তারপর আচমকা বললাম, '
-এখানে তোমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে।'
রতন যেন আমার কথা ভালো বুঝল না।
-তুমি চার নম্বর সেলে আছো না?
-হবে হয়তো বুঝি না,
- চার নম্বরটা সেলটা সবচেয়ে ভালো। স্পেশাল সেল। নতুন হয়েছে। নেতা মন্ত্রীদের জন্য, ওই যারা পাবলিকের হকের টাকা নিজের পকেটে ভরে, তাদের জন্য, বেশ খোলা মেলা  রোদ, বাতাস, স্যানিটারি ব্যবস্থা ভালো। তাই না।
- হ্যাঁ, কিন্তু জানলার বাইরে লোহার জাল।  কম্পাউন্ড ওয়ালের মাথায় কাঁটাতার। আপনাদের লোকজন পাহারা দেয়, বসে থাকে।
- আমি জানি, 
আবার আচমকা বললাম,'
- তুমি গায়ে-মাথায় মাখার জন্যে সাবান-টাবান পাচ্ছ তো? মশার তেল পেয়েছ? এখানে খুব মশা। ম্যালেরিয়া হতে পারে। বি ভেরি কেয়ারফুল।
ভালো কথা, তোমার ডান পায়ের থাইয়ের এক জায়গায় ইনজিউরির দাগ আছে। ওটা কীসের? বোমা-টোমার চোট? 
রতন চমকে উঠল। তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। তার যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না, এই ব্যাপারটা, 
রতন নিশ্চয় বুঝতে পারছে না, আমি তাকে আরও কতভাবে অবাক করে দিতে পারি।
রতন বলল, 'না, বোমার নয়।'
-বোমার নয়। কীসের দাগ?
- ছোটবেলায় একবার চকলেটবোম ফাটাতে গিয়ে হাতেই ফেটে গেছিল।
- তোমার পিঠের দিকেও একটা দাগ আছে।
- তাও দেখেছেন? ওটা আপনাদের অফিসারদের দয়া। রুলের মার। আজকাল বসতে পারি না। পায়খানা করতে পারিনা। রোজ সন্ধ্যায় একবার করে পেটাচ্ছে। পেছনে রুল ডুকিয়ে দিচ্ছে। ভারি কষ্ট স্যর। ওদের বলুন না, আমি চিনি না কাউকে, কে রেখেছে তাও বলতে পারবো না। আমাকে লাইনের ধারে দেখে ধরে নিয়েছে, ওখান থেকে ধরে এনে, হরদম পেটাচ্ছে। বলছে কেসটায় আমাকে হাজতে দেবে। নইলে আমার বোনকে তুলে আনবে, বাবাকে ধরে পেটাবে। 
বলেই রতন কেঁদে ফেলল। আমি ওকে ওয়াচ করছি, তাকিয়ে আছি ওর দিকে, হঠাৎ চোখ মুছে বলল,
- মা বলেছিল পড়াশোনা কর, বাজে ছেলে গুলোর সঙ্গে মিশে নেশা করিস না, শুনিনি স্যর, আজ বুঝতে পারছি, আমি কত বোকা।
আমি ওকে স্বান্তনা না দিয়ে চমকে বললাম,
- বোমাতো বানাতে।
- না স্যর এসব ভুল কথা, আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে,
- যাও রেস্ট নাও। পরে কথা হবে।
রতন চলে গেল, হাঁটতে ওর কষ্ট হচ্ছে, দরজার সামনে গিয়ে একবার তাকালো আমার দিকে, হয়তো কিছু বলতে চায় আমাকে। 

চলবে.......

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ