সহমরণ

সহমরণ
দেবপ্রসাদ জানা

একটা কাক এসে কার্ণিসে বসছে, কি একটা কথা কাকা করে বোঝাতে চাইছে, ঘররের কোনে কারা যেন ফিসফিসিয়ে কথা বলছে বুঝতে পারছি না, সময় থমকে গেছে, অবাক হয়ে বাতাস হাঁ করে দাঁড়িয়ে, আমার দেহটার ওপরে সাদা কাপড়টা বুক পযর্ন্ত ঢাকা, পায়ে আলতা দেওয়ার পর্ব চলছে, চোখে তুলসীপাতা, কপালে চন্দন, আতরের গন্ধ, ধুপ জ্বলছে ঠিক মাথার পাশে, একে তো আতরের গন্ধ, তার ওপরে ধুপ, একটা রজনীগন্ধার মালা গলায়, সেটার ও বেশ গন্ধ, পাশের বাড়ির কতকগুলো বউ আমার গিন্নীকে স্বান্তনা দিতে দিতে, চোখ মোছার ভান করছেন, এর মধ্যে অনেকেই আমি কখনো দেখিনি, আশেপাশে এরা থাকতো আমি জানিই না, পরিচয়ও নেই, বাইরে  আমাকে নিয়ে যাওয়ার পালঙ্ক এসেছে, এক একজন নতুন লোক আসছে আর সকলের কান্নার পর্ব শুরু হচ্ছে, বেশ লাগছে আমার। আমার সঙ্গী, আমার বউ, আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে, মেজো শালীকে বলল, 
- একটু চা কর, ওদেরকে দে, ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট দিতে একটু সময় নেবেন, আধার কার্ডে বাবার নামের বানান, আর ভোটার কার্ডের বানান ভুল আছে, সারাজীবন লোকটা আমাকে জ্বালালো, মরার পরেও শান্তি নেই, আরো কতকি না ভুল আছে কে জানে, আমার কপালে যে কি আছে?
মেজ শালী চা নিয়ে চলে এলো, 
- চা হয়ে গেলো? 
- মেসো করেছে, 
- তোর জামাইবাবুকে একটু দিস, চা খেতে বড় ভালোবাসতো লোকটা। 
এতদিন সংসারে আমিই চা করে খাইয়েছি, এখন আমার গিন্নীর মনে পড়েছে আমি চা ভালোবাসি, 
এক কাপ চা এলো আমার মাথার কাছে, আমার জন্মদিনে বউয়ের কিনে দেওয়া কফি কাপটা নতুন।
- ওই কাপটায় দিলি? অন্য কাপে দিতিস, সবে কিনে দিয়েছিলাম, বাইরের ঘরের মেঝেতে বর্তমানে আমার স্থান হয়েছে, পিঠের নিচে শ্বশুর বাড়ি থেকে বিয়েতে দেওয়া তোসক, বর্তমানে সেটার অবস্থা বিশেষ ভালো নয়, ত্রিশ বছর ধরে তোসকটা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে, ফলে শতছিন্ন অবস্থায় খাটের জাজিমের ওপর কোনক্রমে দিন কাটছিল তার। বোধ হয় আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। বাইরে সেজ শালীর আগমন, একপ্রস্থ কান্নার মহড়া চললো, আমার পায়ে আলতা, তার  ছাপ তোলা হচ্ছে, পা দুটো দুইদিকে লম্বালম্বি হয়ে গেছে, জোর করে সোজাসুজি দাঁড় করানো না গেলে, একজনের পরামর্শে আমার পায়ের বৃদ্ধাঙুলি দুটি দড়ি দিয়ে বাঁধা হলো। ফাঁসি দেওয়ার মতো করে। বুকের ওপর ফুলের তোড়ার ওজন বাড়ছে, মালা গুলো ক্রমশ পর্বত সমান। কে একজন একমুঠো ধুপ জ্বেলে দিয়ে গেল, একটা বাজে গন্ধ আমার নাকে আসছে, গোলাপের গন্ধ, আজ গোলাপের গন্ধে কেমন বিরক্তি আসছে, অথচ যখন বেঁচে ছিলুম, কত গোলাপ কিনে, প্রতি বিবাহ বার্ষিকী তে বউকে খুশি করতে চেয়েছি, বউ বলতো আদিখ্যেতা, যদিও শুধু বউকে বললে অন্যায় হবে, তখন বউয়ের বিরক্তি আসতো এখন আমার আসছে। ধীরে ধীরে লোকজন বাড়ছে, আর শোকের পরিবেশে আমার হালকা খুশি ভাসতে শুরু করেছে, আমার ভাবনা, কল্পনা, চিন্তা এরা কাঁদছে, কি হবে তাদের? এতোদিন কষ্ট করে হলেও সতিনের ঘর করেছে, এবার আর রক্ষে নেই, আমার পায়ের কাছে বসে আছে, তাদের সিঁথিতে লাল রক্তজবার মতো সিঁদুরের মোটা পথ, তারা আমার সহধর্মিনী, জীবনের বহু কষ্ট সহ্য করে এসেছে,  কোনোদিন তাদের লোক সম্মুখে আনতে পারিনি, আমার মৃত্যুর পরে, তারা বড়ই চিন্তিত হয়ে পড়েছে, তোমরা ভেবে দেখো একবার, ভালো করে ভেবে দেখো, এদের ভবিষ্যত আছে কিনা? যদি না থাকে - এই তালা বিহীন ঘরটার মধ্যে রেখে দিয়ে কি হবে? আমি তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম- এখানে আমার শেষ যাত্রায়, শেষ বিছানাটায় পঁচে গলে যাওয়ার থেকে এসো, আমার সঙ্গে সহমরণে। 

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ