কৃষ্ণ ভীষ্ম সংবাদ
কৃষ্ণ ভীষ্ম সংবাদ
পিতামহ ভীষ্ম-
এসো দেবকীনন্দন, স্বাগত জানাই
তোমাকে, অনেকক্ষণ ধরেই তোমার
কথা চিন্তা করিতেছি, দেব নারায়ণ।
হে অন্তরযামী, এই কৌমুদীরাশিতে
কুসুম পল্লব লতা, নিশার তুষারে
শীতল করিয়া প্রাণ, শরীর জুড়ায়
এই শরসজ্জা পরে। উন্মুক্ত অম্বরে-
জীবন পিঞ্জর কাঁদে, যমের তাড়নে।
হেরি মরণের কালো অন্ধকার নিশি।
তব ছলনার সুখে, শান্ত নিশানাথ-
প্রশস্ত নদীর তট বেয়ে, অন্বেষণে
আসে, এই ধর্ম স্থানে, যখন পাগল
মন ত্যজে এ শ্মাশান, কহে বারবার
আমিই কলঙ্কময়, বিষতুল্য কায়া।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
হে শান্তনু পুত্র ভীষ্ম আমি আপনাকে -
কি জিজ্ঞাসা করিব হেথা ? সেটাই বুঝতে
পারছি না, এখন তো, এটাও জিজ্ঞেস
করতে পারবোনা যে, কেমন আছেন।
এহেন তীরশজ্জা পরে, বীরাত্মা বিরাজে
স্বজাতির মুখ আজ, এত মনোহর।
ধরনীতে সদানন্দে আছে একজন
না থাকে সন্তাপে, থাকে সদাহাস্য ভরে।
রাখিল এ ধরাতল, সদা ধন্য করে
তারে আমি কি কহিব? কিবা জিজ্ঞাসিব?
দিবানিশি মানবের হিত, যিনি নিত্য
মনচিত্রে দেখে, করে সুখ অনুভব,
অসার দেখি যে তারে কুরুক্ষেত্র পরে,
তার সাথে কোন বাক্যে গাথিব কথন।
পিতামহ ভীষ্ম
(ভীষ্ম মুচকি হাসলেন তারপর বললেন,)
কহ হে কেশব, কেন বাঁধো ছলনার
জাল, এখনো কি তুমি সেই চক্র হস্তে
দেখিতেছ কুরুক্ষেত্র ভূমি? পশুপতি।
পুত্র যুধিষ্ঠিরের কি, হলো অভিষেক।
হে কেশব? যুধিষ্ঠিরের খেয়াল রাখিও,
গদাধর, হে কেশব, সময়ে এসেছ,
আমার সময় প্রায়, শেষ হইয়াছে।
দক্ষিণায়নের শুরু হলেই সমাপ্তি।
সে তুমি ভালোই জানো, দেব নারায়ণ,
হস্তিনাপুরের রক্ষা, সুরক্ষা। আমার -
জীবনের শেষলক্ষ্য সুরক্ষিত মোর
দেশ হস্তিনা নগর, ও নগর বাসি।
যাওয়ার আগে তুমি আমার মনের
সব ভ্রম গুলি তুমি দূর করে দাও।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
অবশ্যই! কি জানতে চান কহো পিতামহ।
পিতামাহ ভীষ্ম
একটা কথা বল প্রভু, তুমিতো ঈশ্বর।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
(শ্রীকৃষ্ণ কথাটা শেষ করার আগেই বলে উঠলেন)
ওহে পিতামহ ভীষ্ম, আমি যে ঈশ্বর
নই, আমি আপনার পুত্র পিতামহ,
ঈশ্বর নই।
পিতামাহ ভীষ্ম
(হেসে ওঠেন)
নিজের জীবন নিয়ে কখনো নিজে
বিশ্লেষণ করে দেখিনি। তাই জানিনা যে সম্পূর্ণ জীবনটা ভালো ছিল নাকি খারাপ। কিন্তু কৃষ্ণ, এখন তো আমি এই ধরা ভূমি ছেড়ে চলে যাচ্ছি, এখন তো অন্তত ছলনা করা ছেড়ে দাও, প্রভু! এখন তো অন্তত ছলনা করা ছেড়ে দাও।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
শ্রীকৃষ্ণ ভীষ্মের কাছে এলেন এবং হাত ধরে বললেন
বলুন পিতামহ! কি জানতে চান?
পিতামাহ ভীষ্ম
এই যুদ্ধে যেটা হলো সেটা কি ঠিক ছিল?
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
কোন পক্ষের কথা বলছেন পিতামহ?
পাণ্ডবদের কথা?
পিতামাহ ভীষ্ম
কৌরবদের নিয়ে কথা বলার কোনো অর্থই হয়না প্রভু। কিন্তু পাণ্ডবদের দিক থেকে যেটা হলো সেটা কি ঠিক ছিল? ছল করে আচার্যদ্রোণের বধ, দুর্যোধনের উরুতে আঘাত,
দুঃশাসনের দেহ ছিঁড়ে ফেলা,
জয়ধ্রথের সাথে হওয়ার ছল,
নিরস্ত্র কর্ণের বধ এসব কি ঠিক ছিল?
এসব কি উচিত ছিল প্রভু?
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
এর উত্তর আমি কী করে দেবো পিতামহ।
এর উত্তর তো তারা দিতে পারবে যারা এই কাজগুলো করেছে, উত্তর দেবে দুর্যোধনের বধকারী ভীম,
উত্তর দেবে কর্ণ ও জয়ধ্রথের বধকারী অর্জুন। আমিতো এই যুদ্ধে কোথাও ছিলামই না পিতামহ।
পিতামাহ ভীষ্ম
এখনো ছলনা করা বন্ধ করবে না তাইনা কৃষ্ণ
হে কৃষ্ণ! এই বিশ্ব যতই মানুক যে
ভারতের যুদ্ধ অর্জুন ও ভীম জিতেছে
কিন্তু আমি জানি কেশব! যে এই যুদ্ধে কেবল
তোমার শুধু তোমারই জয়। তাই আমি উত্তর তোমার কাছেই চাইবো।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
তাহলে শুনুন পিতামহ, কিছু অনুচিত হয়নি এই যুদ্ধে, কিছু অনৈতিক হয়নি এই যুদ্ধে। সেটাই হয়েছে যেটা হওয়া উচিত ছিল।
পিতামাহ ভীষ্ম
এটা তুমি কি বলছো কেশব! মর্যাদা পুরুষোত্তম রামের অবতার বলছে এইকথা।
এরকম ছলতো কোনো কালেই আমাদের সনাতন ধর্মের অংশ ছিল না। তাহলে এটা কি করে উচিত হল কৃষ্ণ।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হয় পিতামহ।
কিন্তু নির্ণয় বর্তমান পরিস্থিতির উপর নির্ভর করেই নিতে হয়। প্রত্যেকটা যুগ তাঁর অবস্থা ও পরিস্থিতির আঁধারে যুগনায়ক বেছে নেয়। রাম ত্রেতাযুগের নায়ক ছিল কিন্তু, আমার ভাগ্যে দ্বাপর যুগ এসেছে। তাই আমাদের দুজনের সিদ্ধান্ত কখনই এক হতে পারে না পিতামহ।
পিতামাহ ভীষ্ম
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না কেশব। আমাকে একটু বুঝিয়ে বলো।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
রাম ও কৃষ্ণের পরিস্থিতির মধ্যে অনেক পার্থক্য পিতামহ। রামের যুগে শত্রু রাবণের মত একজন শিব ভক্ত ছিলেন, একজন সাধক ছিলেন, সেইসময় রাবনের মত অশুভ শক্তির পরিবারেও বিভীষণ ও কুম্ভকর্ণের মত সাধু ব্যক্তিরা ছিলেন। তখন বালির মতো খলনায়কের পরিবারেও তারার মতো বিদুষী স্ত্রী, অঙ্গদের-এর মতো সৎ পুত্রও ছিল। সেইযুগের খলনায়কও ধর্মের জ্ঞান রাখত। তাই রামও তাঁর সাথে কখনো ছল করেনি। কিন্তু আমার যুগের ভাগ্যে কংশ, জরাসন্ধ, দুর্যোধন, দুঃসাশন, শকুনি ও জয়ধ্রথের মতো পাপীরা আসে। আর এদের শেষ করার জন্য,
সকল ছলই উচিত পিতামাহ। পাপের শেষ করতেই হতো, আর সেটা যেকোন পথেই হোক।
পিতামাহ ভীষ্ম
তাহলে কি তোমার এই নির্ণয়ের জন্য ভুল পরম্পরা প্রচলন হবেনা? ভবিষ্যৎ কি তোমার এই ছলের অনুসরণ করবে না? আর যদি করে তাহলে সেটা কি উচিত হবে?
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
ভবিষ্যতেতো এর থেকেও অসভ্য কিছু আসতে চলেছে পিতামহ। কলিযুগে এতেও কাজ হবে না। কলিযুগে মানুষকে এর থেকেও অধিক কঠোর হতে হবে। তা না হলে ধর্ম সমাপ্ত হয়ে যাবে। যখন কুট ও অনৈতিক শক্তিরা ধর্মকে নাশ করার জন্য আক্রমণ করে তখন নৈতিকতা অর্থহীন হয়ে যায় পিতামহ। তখন প্রধান হয়ে ওঠে বিজয়, কেবল বিজয়। ভবিষ্যৎকে এটা শিখতেই পিতামহ।
পিতামাহ ভীষ্ম
ধর্মেরও কি ধ্বংস হতে পারে কেশব?
আর যদি ধর্মের নাশ হওয়ারই হয়, তাহলে কি মনুষ্য এটাকে আটকাতে পারে?
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
সবকিছু ঈশ্বরএর ভরসায় ফেলে রাখা মূর্খতা পিতামহ। ঈশ্বর নিজে কিছু করেন না, সবকিছু মানুষেই করতে হয়। আপনিতো আমায় ঈশ্বর বলেন পিতামহ, তাহলে বলুন পিতামহ আমি কি যুদ্ধে কিছু করলাম? আমি কি এই যুদ্ধে কাউকে বধ করলাম? সবকিছু পাণ্ডবদের করতে হলো। এটাই প্রকৃতির সংবিধান, এটাই তো বলেছিলাম আমি অর্জুনকে। আর এটাই পরম সত্য।
পিতামাহ ভীষ্ম
(ভীষ্ম পিতামাহ এই উত্তর শুনে সন্তুষ্ট হলেন। )
(ওনার চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। )
হে শ্রীকৃষ্ণ এই ধরাধামে আমার শেষরাত্রি।
কাল সম্ভবত চলে যেতে হবে, তোমার এই অভাগা ভক্তের উপর কৃপা করো প্রভু।
(শ্রীকৃষ্ণ মনে মনে কিছু বললেন এবং প্রণাম করে সেখান থেকে চলে গেলেন। )
যুদ্ধভূমির সেই ভয়ানক অন্ধকারে ভবিষ্যৎ তার জীবনের সবচেয়ে বড় সূত্র পেল। যখন কুট ও অনৈতিক শক্তিরা ধর্মকে নাশ করার জন্য আক্রমণ করে তখন নৈতিকতার পাঠ অর্থহীন হয়।
Comments
Post a Comment