স্বর্গপথে যুধিষ্ঠির

স্বর্গ পথে যুধিষ্ঠির 
দেবপ্রসাদ
[ হিমালয় অতিক্রম করে স্বর্গের সিংহদ্বারে এসে পৌঁছেছেন যুধিষ্ঠির।
একজন দেবদুত তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন।] 
 
যুধিষ্ঠির -
স্বর্গ! শশী তনুছটা, পড়িছে উথলি
দেবক্রীড়া করে দেখি, কিন্নর কিন্নরী
মন্দাকিনী দেবাপ্সরা গগন প্রাঙ্গণে
কিরণের রজ্জু যেন মহাতেজস্কর।
অসংখ্য গন্ধর্ব গলে সঙ্গীত ঝরিছে
দেব অট্টালিকা পরে ফুল পারিজাত।
মধুর নিনাদে ঘোরে জ্যোতিষ্কমণ্ডলী
এই কি সেই স্বর্গ, হে দেবতার দূত
অবাকে নিরখি আমি যে অমরালয়
উচ্ছাসে বহিল মন, শ্রবণে ভরিছে
কর্ণ কুহর, মধুর অমর সঙ্গীতে।
বাজিছে দুন্দুভি বাদ্য ত্রিলোক ব্যাপিয়া
অপুর্ব সৌরভ বহে, এই দেবালয়
সুখ নিদ্রা যায় বুঝি দেবতা সকলে?
 
দেবদূত-
নিদ্রা যায় দেবগণ সুধার সুগন্ধে
ধর্মপুত্র, ঐ অদূরে তোমার ঈপ্সিত
নগরীর অতুলিত , সুধার সুগন্ধে
আনন্দে শশাঙ্ক শশী অপুর্ব আকারে
অমল সুন্দর দৃশ্য, বিত্ত মনোলোভে
ঐন্দ্রজালিক বিশ্রুতি, বিভূতি মহিমা
বিচিত্র আশ্চর্য চারু ললিত সুন্দরে।
ঐ যে শুভ্র মেঘছায়া তলে পারিজাত
অসংখ্য গন্ধর্ব দেব খেলিছে কাননে
ঐ যে সোহাগের গান বাজিছে গগনে
গিরি উপবন রহে প্রণয়ে বিধুর
অমর নীরব সেই কমল কানন
তার পাশে বহে ধীরে নদী মন্দাকিনী
এই সেই স্বর্গ তব ঈপ্সিত নগরী।
 
যুধিষ্ঠির -
এই স্বর্গ? হিমস্বরে অসীম নৈঃশব্দে
সপ্তর্ষিমণ্ডল পার হয়ে, বাধাহীন
স্বর্গের প্রতিটা সিঁড়ি পার করে সেই
পরম আকাঙ্খিত এ স্বপ্নভূমি মোর,
ধর্মদণ্ড মোর পড়ে থাকবে অতীব
অনাদর জীবনের, জীবন মধ্যাহ্নে
ধুম্রজাল ভেদ করে আসি, হারিয়েছি
পথে আপনার সব, মনের বাসনা।
কুসুম চন্দনে ভরি, আরাধ্য দেবতা
তাম্বুল কর্পূর দিয়ে করি আরাধনা
তবুও হয়নি তুষ্ট, ইষ্ট দেব মোর,
রাহু গ্রাসে শশধর, গিয়েছে হারায়ে
লক্ষ লক্ষ মানুষের, করিয়া নিধন
এই নাকি ভবিতব্য, শাস্ত্রের লিখন।
 
দেবদূত -
হরিষ বিষাদ এবে তুল্য চিরদিন
বুদ্ধি বীর্য বাহুবলে,সুধন্য জগতে
কালজয়ী ইতিহাস, হিমালয় পারে
সহস্র বিদ্যুতে গড়া বৈদূর্য খচিত
স্বর্গের দ্বার মেঘের ব্যঞ্জনায় স্নিগ্ধ,
কিছু দৃশ্য, দেখিতেছ খানিক অদৃশ্য
এই দ্বার পার হলে, সেই দেবসেব্য
নন্দনকানন, এক পাশে শব্দহীন
স্রোতস্বিনী মন্দাকিনী  নদী অন্তরীক্ষে
দীপ্তি প্রভা বালুরাশি তটে ছায়ালোক
হে ধর্মপুত্র সানন্দে পূর্ণ করো তব
আকিঞ্চন অভিলাষ, ওই দেখা যায়
মহা পূণ্য স্বর্গদ্বার, আলোছায়া তলে।
মানব দেহধারীর আকাঙ্খিত ধাম।
 
যুধিষ্ঠির -
মায়া, মতিভ্রম নয়? এই স্বর্গভূমি?
আকাশ পয়োধি নীরে, ছড়িয়েছে আলো
কাঁপিছে যাহার তেজে অবনী মণ্ডল
সৌভাগ্য কিরণজালে, কালের নিয়ম
আর বেশি দেরি নেই পাবো তার ছোঁয়া
কোথা সেই ইন্দ্রালয় কোথা সে কৈলাশ
ভাবিয়া হুতাশ মন, সদা অভিলাষে
আজ যেন স্বপ্নময়, তরঙ্গের কোলে
ঐশ্বর্য ভাণ্ডার লয়ে, কারা মোরে যাচে
নিয়তির গতি রোধ দগ্ধ কালানল
পদ্মের মৃণালে দোলে  মহাসমাদরে।
সম্মুখেই ইন্দ্রালয়, স্বর্গ বলি যারে
সদা আনন্দিত মন বেদ বেদান্তের
দেশে আছি, অবিশ্বাস্য, ওহে অবিশ্বাস্য।
 
দেবদূত -
বিশ্বাস হচ্ছে না? ওই যে অমরপুর
ওই মেঘের আড়ালে রামধনু ঘোরে
সুগন্ধি বাতাস বয় সুখের তরঙ্গে
বসন্ত পঞ্চমী তিথি, কুসুম প্রণয়ে
কৈলাশ শিখরে ঘোরে ওম শব্দধ্বনি
ডম্বরু বাজে মৃদুল মৃদুল ঝঙ্কারে
হরি গুণোগান করে মহর্ষি নারদ
সুহৃদ সঙ্গম লাগে শ্যামের বাঁশিতে
শুভ্রধুম্র বহে দেখো উথলিয়া স্রোতে
উঠেছে নক্ষত্র হেথা কোকিলের ডাকে
স্বর্ণতরুতলে বসে অপ্সরার দল
মরি কিবা মনোলোভা ছড়ায়ে রয়েছে
তবু কেন অবিশ্বাস তোমার বিরাগে?
নিজ চক্ষে ধর্মপুত্র করো অবধান।
 
যুধিষ্ঠির -
অবিশ্বাস নয় দূত, প্রগাঢ় বিস্ময়….
জানি কল্পনার সঙ্গে মেলে না বাস্তব,
চোখে দেখা শ্রেষ্ঠতর স্বপ্নের নির্মাণ
কিন্তু স্বর্গ, বাস্তবের শেষতম রূপ,
অসীমের চিরস্থির সৌন্দর্য প্রতিমা
এই কি সে স্বর্গ, কেন মনে হচ্ছে মোর
সংক্ষিপ্ত, সীমিত অল্প, আমার স্বপ্নের
স্বর্গ যেন অন্য, যেন আরো কিছু দূরে।
আরো কিছু ছিল সেই স্বপ্ন শহরের
স্বজাতি শোকের শেল বিঁধে আছে বুকে
তবুও স্বর্গের ছবি,  এঁকেছিল মন
স্বপ্নের রঙিন ছবি, ছিল হাতে আঁকা
হারিয়ে গিয়েছে তাহা, বাস্তবের টানে।
তবু মনে হয় এই ছিল এই নেই।
 
দেবদূত -
হে পাণ্ডব কুলপতি, কুন্তীর নন্দন
আপনার সন্দেহের, নজির সঠিক।
স্বপ্নে দেখা স্বপ্নস্বর্গে কেউ কদাচিত
পৌঁছোতে পারে না,জানি অথচ তা দূরে
নয়। প্রকৃত স্বর্গও কিন্তু সম্পূর্ণ বাস্তব।
এই স্বর্গ সিংহদ্বার, অনন্ত বসন্ত
যেথা, অনন্ত যৌবন, অনন্ত প্রণয়ে
নিশি স্নিগ্ধকরী জেগে রয় অনুক্ষণ।
ওই নন্দনকানন রূপ বদলায়
প্রতিদিন, পুর্ণ শশী রূপের ভিতরে
মধুর প্রেমের মত মধুর গাথায়
সুখের তরঙ্গ যেথা হৃদয় কিরণে
উন্মত্ত হইয়া আশা মোহ মায়া প্রেমে
আকাশ তারার নীড়ে নিজেকে হারায়।
 
যুধিষ্ঠির -
এই সেই পূণ্যবৎ স্বপ্ন সুবিদিত
নন্দনকানন, বৃক্ষ পুষ্প, গুল্ম লতা
হেথা সম্পূর্ণ অচেনা, সুধা প্রণয়ের
গীতে প্রাণ পুলকিত, হেথা সুললিত
স্বরে পক্ষী গাহে গান, এ কোন পক্ষীর
সুমধুর কন্ঠ? আগে স্বপ্নেও দেখিনি
দেবদূত,আমি জেগে আছি? না নিদ্রায়?
আহা এইরূপ শোভা, অতি অপরূপ
উথলয় ভাব মোর, বিলাস বিভ্রমে,
সরসী সরিৎ সিন্ধু যেন মেঘমালে
তড়িতের চমকও এত মনোলোভা
মনিময় চন্দ্রাতপ শোভা, সুশোভিত
পরিখায় জগতের, দুঃখ দূরে যাবে।
এও কি সম্ভব? এই  দুরূহ যাত্রায়?
 
দেবদূত -
অসম্ভব এই যাত্রা, আপনি সম্ভব
করেছেন, আপনিই প্রথম মানুষ,
এই শরীরী মানুষ, যার মনোবলে।
সকল যুদ্ধের চেয়ে, সর্বোত্তম জয়।
হে মহান ধর্মপুত্র, মৃত্যু অতিক্রম
করে এসেছেন এই পার্থিব আকারে
এই স্বর্গে! ধন্য ধন্য হে কৌন্তেয়,তুমি
ধন্য ওই ধরা ধাম। পারিজাত মাল্য
লয়ে অপেক্ষা করছে দেব দেবরাজ।
সেই মাল্য স্পর্শে দূর হবে আপনার
সব ক্লান্তি। মহাধুমে, এই স্বর্গেভূমে,
উড়িবে  পতাকা, ওই দেখো,চেয়ে দেখো
হোথা আরো একবার, কোমল কুসুম
মাল্য হাতে দেবরাজ ইন্দ্র অপেক্ষায়।
 
[দ্বারের কাছে দেখা গেল একজন সুপুরুষকে,
তিনি উচ্চকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন :]
 
দুর্যোধন :
কে আসে, কে আসে এই নতুন অতিথি?
প্রভাতী অরুণোদয়, প্রফুল্ল যেমন
ধরিয়ে অপুর্ব বেশ, বিমল স্বভাবে
সুগন্ধ বাতাস মাখা, স্নিগ্ধ মধুময়
রূপ, মনমুগ্ধ মায়া, সুচারু পবিত্র
তুষারের ন্যায় শুভ্র, আলোক ছটায়
এ স্বর্গ ভূমির আলো, আরো আলোকিত।
আনন্দলহরী যেন অতুল আনন্দে
চারি পাশে যার ঘন কুহুধ্বনি বাজে
নীরবে মধু গীতের অস্ফুট কাকলি
কে এই মহাত্মা এই স্বর্গ কুঞ্জধামে।
স্বভাবে শিশুর ন্যায়, কলকণ্ঠ স্বরে
স্বর্গ পবনে বহিছে ঘ্রাণে সুবাসিত
মধুর সঙ্গীত, এই দেব কুঞ্জধামে।
 
দেবদূত :
যাকে খুঁজছেন, তিনি মোটে ইনি নন,
কিন্তু ইনি সর্বোত্তম, স্বর্গের অতিথি।
ইনি স্বভাবের গুণে, অতি মনোহর
ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, সরসীর নীর,
সদা মধুময় বীর, এই ইন্দ্রধনু।
গিরি তরু বায়ু জল ন্যায় সুকোমল
উৎসাহ ভাসিত যার বদন মণ্ডল,
সুনীল অম্বরে ভাসা, শুভ্র মেঘরাশি।
সদা সুখপুর্ণ মহী, সুখপুর্ণ মন।
মহাবলে বলী ইনি রসে সুরসিক।
সিক্ত করি পৃথিবীরে মনুষ্য শরীরে
গিরি কান্তার মরুর পথ অতিক্রমে
দেবভূমি স্বর্গ পুরে, সানন্দে গৃহীত
এই মহাপ্রাণ প্রভা,  সূর্যকান্ত মনি।
 
যুধিষ্ঠির :
কে ঐ দিব্যকান্তি, সৌম্য, ধীরোদাত্ত
সুকণ্ঠ পুরুষ কোন দেব? দেবদূত,
সুরেন্দ্র লোকের প্রায় সুরভি বহিছে
নন্দনকাননসুখে  অতুলিত রূপে
একি সেই দেবতার প্রফুল্ল সুবাস
ওই সৌম্যকান্তি দেহ, অপরূপ রূপ
এতো দেবতা বিনে আর কেউ নয়,
বিকশিত তামরসে অলি উড়ে আসে
প্রকাশিত প্রতিভায় এ অতুল শোভা
দৃষ্টি মাত্র সরমের, দুটি আঁখি বলে
ধন্য ধন্য এই রূপ মাধুরীর ছটা
সরল সুশীলমতি বোঝেনি সন্ধান
নীরবে কহিছে ডাকি হেরিলাম যারে
সেকি কোন দেবদূত না কোন দেবতা?
 
দেবদূত :
এখনো দেবতা নন, কিন্তু ব্যবহারে
দেবোত্তম, বিত্ত সিদ্ধি বিভূতি বৈভব
শাস্ত্রজ্ঞ যাজ্ঞিক ঋষি, সদবংশ জাত
কুলধর্ম অনাসক্ত, নীতি পরায়ন।
স্বভাবে ললিত চারু ভারি মনোরম
চেয়ে দেখো, একবার হে সুবর্ণকান্তি।
মহারাজ ধর্মরাজ, পাণ্ডুর নন্দন
মহাভারোত্তম ঋক্ষ, করো অবধান।
ক্লান্ত, ধূলিধূসরিত দেহ, দুই চক্ষু-
আবিল, বিশ্রাম আশু প্রয়োজন,
ধর্মরাজ, তাই এই  বিভ্রান্তি বিভ্রম
পুনরায় দেখে নিন, উনি কুরুরাজ
দুর্যোধন, আপনার ভ্রাতা, পূর্বজন্মে
কুরুপতি নরপতি,  রাজা দুর্যোধন।
 
যুধিষ্ঠির :
দুর্যোধন? যাকে আমি সেই কুরুক্ষেত্রে
পাপযুক্ত, ভগ্ন-ঊরু, ক্লেদাক্ত, নির্জীব
অবস্থায় শেষ দেখি, দুই চক্ষে ছিল
বিষজ্বালা পরাজয়ে, অতিব কুণ্ঠিত
হতমান, অন্তর্হিত বংশের মহিমা।
ওর ওই দিব্যকান্তি রূপ, ঋদ্ধিমান।
গগনে কিরণোদয় অরুণ স্ব-দৃশ্য
চন্দ্রকলা সম শান্ত, ভাসিছে অম্বরে।
এত পাপ অত্যাচার, পাপিষ্ঠ কোপন
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে যারে, দ্বেষ বৈরিতায়
এক টুকরো মাটির জন্য বৈরীভাব
হিংসায় ঈপ্সায় তীব্র নিষ্ঠুর কর্কশ
হতে দেখেছি,এ কোন অদ্ভুত কারণে,
তার এত প্রশান্ত শ্রী, এযে অসম্ভব।
 
দেবদূত :
হে রাজন, এ যে স্বর্গ, এখানে তো মুছে
যায় পার্থিব কলঙ্ক। মন্দাকিনী স্নাত
পবিত্র সবাই, ন্যায় নিষ্ঠ ক্ষাত্র ধর্ম
মেনেছেন আজীবন যিনি, বেদমন্ত্রে
তিনি সমৃদ্ধ, যাজ্ঞিক ঋত্বিক শাস্ত্রজ্ঞ
সমস্ত সমরে যিনি ঋজু, শঙ্কাহীন
রণভূমে অকাতরে করে প্রাণ দান,
কালদন্তে প্রতিক্ষণ, হইতেছে চূর,
সুগন্ধি কুসুমে শোভে, নানা আভরণে
নিরন্তর প্রিয়তর, নব ভাবে চলে,
ধর্ম আচরণ করে, মহাপুণ্য বান
পাইবে আনন্দধাম, অতি সুমধুরা
অমর নগরী পরে, দেহান্তর মাত্র
কালের পরশে হয়, স্বর্গ অধিকারী।
 
যুধিষ্ঠির :
ন্যায় নিষ্ঠ ক্ষাত্র ধর্ম? উগ্র দুর্যোধন?
যাজ্ঞিক ঋত্বিক ঋষি, বেদজ্ঞ শাস্ত্রজ্ঞ
আশ্চর্য! হে দেবদূত একি শুনি কানে
বিশ্বাস হয় না মনে, সপ্তরথী লয়ে
চক্রব্যুহ মাঝে এক, নিষ্কলঙ্ক শিশু
অভিমন্যু কে কুটিল চক্রান্তের জালে-
নিরস্ত্র নিষ্পাপ এক, অবোধ কিশোর
তাহারে অবলীলায়, হত্যা করা ধর্ম?
নাকি দ্রৌপদীর কেশ, ও বস্ত্র হরণ
তাও ঋত্বিক ক্ষত্রিয় নীতি সিদ্ধ কর্ম?
অবলা নারীর বস্ত্র, মুক্ত সভা মাঝে
হরণ করাও ধর্ম? নাকি কপটতায়
রাজ্য ছিনিয়ে নেওয়া, নাকি যতুগৃহে
পুড়িয়ে মারার ছকে, পাণ্ডু বংশ ধ্বংস?
 
দেবদূত :
এখন সে সব তর্ক বৃথা, যুধিষ্ঠির
ভ্রাতৃহত্যা, বংশধর-সর্বনাশ ত্রাস -
কে করেছে, কে করেছে, রাজা যুধিষ্ঠির?
পৃথিবীর গড়া পাপ, হত্যার কুযুক্তি,
দূত ক্রীড়া, ফেলে আসা পৃথিবীর ভূমি
সীমারেখায় বাঁধন দিয়ে, চারিদিক
পঙ্কিল কাহিনী এক, গাথিছে ধরণী
বিষাদ বারিদরাশি হৃদয় ঘেরিল।
ধূলায় ধূসর তনু,প্রমাদ গুণিল।
এ কাহিনী মানুষের, দেবতার নয়।
ভুলে যান, মহারাজ, ক্লেশকর স্বপ্ন
অগ্নিসংযোগে যাহারা, পঞ্চ পাণ্ডবেরে
অগ্নি দগ্ধ করে দিতে চেয়েছিল, তারা-
আপনার ভ্রাতা, তারা পাবকে পতঙ্গ।
 
 
(দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরকে চিনতে পারলেন।
সাগ্রহে এগিয়ে এসে সপ্রেমে আলিঙ্গন করলেন ধর্মরাজকে।
কিন্তু যুধিষ্ঠির সম-ব্যবহার করতে পারলেন না।]
 
দুর্যোধন :
প্রিয় ভ্রাতা, যুধিষ্ঠির, আজ ধন্য আমি
তোমার স্পর্শের পুণ্যে, তোমার সান্নিধ্যে,
শুধু সত্যের সৌরভ, সেই ঘ্রাণে ধন্য,
আজ আমি স্বর্গ সুখে, সুখী হবো তাই।
ক্ষত্রিয়ের জ্ঞাতি যম, জীবন যৌবনে।
তবু  যম যারে ছুঁয়ে দেখে নাই ভবে।
সন্ধির পতাকা শুভ্র, গগনে উঠায়ে-
আসিলেন শেষে এই, দণ্ডির আশ্রমে।
সমস্ত মানবকূলে, তুমি অদ্বিতীয়
সশরীরে স্বর্গে এলে, শশধর কর
আমরা সেই গৌরবে, ফুল্ল পুষ্প দল।
আমাদের বহুদূর, পিতা পুরুরবা
তোমার কীর্তির কাছে ম্লান অপ্রকাশ।
এসো জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মোর করি আপ্যয়ন।
 
( যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের এই ভাষা বুঝতে পারলেন না।
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।)
 
দেবদূত :
এবার চলুন দেব, কুন্তীর নন্দন
স্বর্গের দুয়ার পার হয়ে ইন্দ্রপুরে
যেখানে পশিলে পাবে মহাসুখ
অস্থির হৃদয় হবে, শান্ত সুধাময়।
আনন্দ মঙ্গল বাদ্য, বাজিতেছে সদা,
হাস্যমুখে দেবরাজ, ইন্দ্র সভা মাঝে
সহস্র নর্তকী সহ, পুজিবে প্রণয়ে,
মুগ্ধ হয়ে রূপরসে, মায়া পরবসে
মোহন মুরতি চিত্র দেখিবে সেখানে।
বিভূষিত হবে তব, অস্থির হৃদয়।
আর কেন অপেক্ষায় থাকো নৃপবর
চলে এসো, স্বর্গদ্বার হতে এইক্ষণে
বিলম্ব উচিত নহে, এসো হে সত্বরে
আর দেরি নয় যাই, অমৃত নগরে।
 
দুর্যোধন : 
ক্ষণেক দাঁড়াও ওহে, দেবতার দূত!
ওহে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, চেয়ে দেখ, শিলাখণ্ডে
আবিষ্ট আসীন, মম সবার নমস্য,
উনি সূর্য পুত্র কর্ণ, কবজ কুন্ডল
ধারি, কুরু পাণ্ডবের, সর্ব জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা।
কুরুক্ষেত্র যারে দিলো, শুধুই বঞ্চনা
ধুলো হয়ে মিশে ছিল হারায়ে সৌরভ।
হে দণ্ডপালক দেখো, ঘুরে একবার
এই সেই উনি যার পাণ্ডব নাশের
সকল শক্তি থাকার পরেও করেনি,
মায়ের কাছে দেওয়া কথার খেলাপ।
গুণরাশি যত তার, শোনাই তোমারে
শেষ নাহি হবে তার, সেই গুণগাথা।
এ যে প্রথম কৌন্তেয়, মহাবীর কর্ণ।
 
যুধিষ্ঠির :
প্রথম কৌন্তেয়? তাই হায়রে বিধাতা
প্রথিতযশা জননী কুন্তীর আমি যে
প্রথম সন্তান নই, হ্যাঁ জানি, জেনেছি,
তবে এমন সময়ে, বিদ্বেষের অগ্নি,
পুড়িয়ে দিচ্ছিল মন, তবু মনে হয়
সশরীরে স্বর্গাগত, এই যুধিষ্ঠির,
ভূপাতিত, স্থির নেত্র, প্রাণহীন সেই
মহাবীরে আকৈশোর চরম ঘৃণায়
ভয়ে ও বিদ্বেষে তারে চিরশত্রু বলে
মনে মনে জানি, তিনি পঞ্চ পাণ্ডবের
সহোদর? সে অগ্রজ! এই জানাটাও
কি কঠিনতম শাস্তি নয় দুর্যোধন?
এ যেন মায়ের হাতে, নির্দয় প্রহার!
বিনা দোষে অগ্নি দগ্ধ প্রায় হুতাশনে।
 
দেবদূত :    
শান্ত হোন! শান্ত হোন! ওহে ধর্মরাজ
যুধিষ্ঠির। যন্ত্রণার দিন গুলি শেষ,
বিশেষ দুর্গম পথ পাষাণে রচিত,
ভুজঙ্গের গতি সম, বেদনার ক্ষণ
ক্রমে ক্রমে পরিহার করে আলোকের
পথে, নিয়ে চলো ওহে রাজা যুধিষ্ঠির।
পাইবে আনন্দধাম, অমর নগরী
স্বর্গদ্বারে স্বর্গসুখ, প্রতীক্ষা করিছে
নয়ন তপন করে হাস্য প্রকাশিবে
এতএব আর কেন যাতনা কঠোর
স্মৃতি, মনে মনে বয়ে নিয়ে ধরাশায়ী।
মোহ মেঘ ক্রোধাম্বিত বাসনার বিষ
পান করিবার তরে, আশু আকাঙ্ক্ষিত।
সন্ধি অভিলাষ ভাসে, দ্বিতীয় পাণ্ডব।
 
যুধিষ্ঠির :
আমি দ্বিতীয় পাণ্ডব! জননী আমার
যে সিংহাসনের, উষ্ণ উত্তাপের জন্য
অগনতি নৃপবর, দ্বিধাহীন মৃত্যু
আলিঙ্গন করিয়াছে, সেই সিংহাসন
গৌন পাণ্ডবের? রাধেয় কর্ণের?
তার মস্তক পরে সেই তাজ রবে?
যিনি জ্যেষ্ঠ, তিনি কর্ণ, তবে কেন এত,
ক্রোধ, হানাহানি, হিংসা, এত রক্তপাত
মহাকুরুক্ষেত্ৰব্যাপী আত্মীয় বন্ধুর
ছিন্নভিন্ন পচা গলা শব, কোলে করে
জায়া-জননীর সেই,  মৌন হাহাকার।
ভাই দুর্যোধন, ভুল করেছি, মিথ্যেই
আমি তোমাকে কপট, স্বার্থান্বেষী বলে
কত কূট কথা ভেবে, হৃদয়ে দিইনি স্থান,
 
দুর্যোধন :
কেন করো অনুতাপ হে ধর্ম নন্দন,
এখানে তো ক্রোধ নেই, ভ্রাতা যুধিষ্ঠির।
ক্রোধ, তাপ অনুতাপ, সব অর্থহীন,   
এখানেতো শত্রু নেই, প্রেম ভালোবাসা, 
ভরা অপার মিত্রতা, সুধার সদন  
সুখ পরিপূর্ণ খনি , সুধা সিক্ত ইন্দু
অমৃত ভাণ্ডার নিয়ে অকল্পনীয় স্পর্ধা
অপূর্ব মোহন সাজে ঘোরে দেব দেবী
তার নাম অবিমিশ্র সুখ, স্বর্গরাজ্য
ডাকিছে তোমারে ভ্রাতা, অনাবিল সেই
আনন্দ পশরা লয়ে, তব অপেক্ষায়
দেবতারা স্বর্গদ্বারে, পারিজাত ফুল
হাতে স্বর্গ লোক, কেন সেই অশান্তির
কুরুক্ষেত্র আন ভ্রাতা, এই স্বর্গ ধামে
 
দেবদূত-
স্বর্গের সমস্ত সুখ বাসনা-সম্ভব
যার যার ইচ্ছেমত মুহূর্তে নির্মিত 
হবে গৃহ, এই স্থানে কালস্রোত নেই।
কোনো কিছু সূর্যতাপে পুরোনো হয় না।
সব রমণী স্বাধীনা, স্বেচ্ছাপ্রণয়িনী।
সম্পর্ক শৃঙ্খল নেই, অথচ প্রত্যেকে,
প্রত্যেকের তরে। খাদ্য ও পানীয় 
সব চোখের নিমেষে, এসে যাবে কাছে।
এই সব কিছু আজ আপনার ভোগ্য, 
পবিত্র সলিলা নদী, এ মন্দাকিনীর
জল স্পর্শ করে নিন। শরীর-চৈতন্য 
শুদ্ধ হবে। দেহ আছে, তবু দেহহীন,
পরমায়ু আছে, তবু মৃত্যুহীন দেহ।
অমৃত ভাণ্ডার আছে, তাও অফুরন্ত।


দুর্যোধন -
ওহে ভ্রাতা যুধিষ্ঠির, মানবজীবনে 
যাঁকে প্রণাম করোনি,সেই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা 
কর্ণ, তব অপেক্ষায়, তাঁকে একবার
সম্ভাষণ না করেই, চলে যাবে ভ্রাতা?
দেবের সদৃশ্য এই, মহামতি গণ
যুগে যুগে সঞ্চারিল জ্ঞান, সদাচারে
এখনও ফিরে দেখো নাই, ধর্মপুত্র
জগতের গতি জেনো, বিধাতার দান
দুঃখ শোক বাসনার, সেই মর্ত ভূমি
সেখানে লালসা ছিল, ভালোবাসা ছিল
আঁধারে ডুবিয়া তাও হলো ছারখার 
আর কেন ভ্রাতা এই মানব সৃজন।
ভ্রমেতে ডুবিয়া আছো, বৃথা এ সকল
সকলি নিস্ফল মেনো, ভ্রাতা যুধিষ্ঠির।
 
(যুধিষ্ঠির সঙ্কোচ ও লজ্জায় উত্তর দিলেন না। এই সময় কর্ণ উঠে দাঁড়িয়ে এদিকে ফিরলেন। 
জ্যোতির্ময় পুরুষ, তাঁর অঙ্গে কবচকুণ্ডল ফিরে এসেছে। কৌতুক-হাস্য মাখা মুখ।]
 
কর্ণ :
এসো যুধিষ্ঠির, দেখো ঘুরে একবার 
মনুষ্য শরীরে, তাই এখনো যায়নি 
তব মানবিক দ্বিধা, ক্ষত্রিয় নন্দন।
পরহিতে দেশহিতে, তুল্য নাই তব
এসো যুধিষ্ঠির, স্বর্গে স্বাগতম্ তুমি
তোমার পায়ের স্পর্শে, এই স্বর্গভূমি, ধন্য, আমার অনুজ, জেনো চিরকাল 
তুমি আমার শ্রদ্ধেয় হে ধীমান, তুমি 
সকলের চেয়ে বড়, বীর যুধিষ্ঠির 
ভূলোক-দ্যুলোক জয়ী, ক্ষত্রিয় তনয়।
সার্থক জীবন তব। স্বর্গ সুখে সুখী
হও তুমি। প্রবেশিয়ে এই স্বর্গপুরে
উপনিত হও স্বর্গে, ভুলে যাও ব্যথা
বসাব তোমারে আমি, বিচিত্র আসনে।


যুধিষ্ঠির -
হে অগ্রজ, হে কৌন্তেয় ক্ষমাপ্রার্থী আমি, যে নির্মলচিত্তে, লইলে আপন

করে, বিধাতার কোন অভিশাপে, ভ্রাতা-

লুকিয়ে গিয়েছ তুমি, কোন অন্তরালে।

ক্ষমা করো ক্ষমা করো 

আগেই বলেছি ভাই, এখানে ক্ষমার 
প্রশ্ন নেইভূপৃষ্ঠের কর্মফল ভেবে 
আর উতলা হয়ে না


কর্ণ :
পাথরে-কন্টকে সার, এই রুধিরাক্ত, 
ক্ষত-বিক্ষত শরীর, আহা কত কষ্টে 
পার হয়েছো কঠিন, এই হিমালয়
মানবকুলের শ্রেষ্ঠ অভিযাত্রী তুমি, 
সবার প্রণম্য যাও, বিশ্রাম ভবনে।
এখনো সম্পূর্ণ গ্লানি, মুক্ত নয় তুমি  যুধিষ্ঠির, 

তাই রুদ্ধবাক

      

 দেবদূত, 

তুমি ওঁকে পুণ্য স্নানে নিয়ে যাও!
 
(যুধিষ্ঠির সত্যিই কর্ণের সামনে আর কোনো কথা বলতে পারলেন না। দেবদূত তাঁকে নিয়ে চললেন নন্দনকাননের অন্য প্রান্তে।]

যুধিষ্ঠির :.
স্বর্গের এ সিংহদ্বারে রয়েছে আমারই দুই ভ্রাতা আর কেউ নেই কেন?
দেবদূত :
সুক্ষ্মদর্শী যুধিষ্ঠির, এ প্রশ্ন সঠিক
এ এক অতুল কীর্তি, সশরীরে স্বর্গে 
পদার্পণ,এর জন্য সুবিশাল সমারোহ, 
আনন্দ উৎসব আয়োজিত হয়েছে এ স্বর্গভূমে আজ কিন্তু ইন্দ্র আর সব জ্যোতিরিন্দ্রগণ অপেক্ষা করছেন কিছু দূরে!

যুধিষ্ঠির :
কৌতূহল মার্জনা করুন, দেবদূত
কেন দূরে? পুত্ৰ অভিমন্যু, পিতামহ ভীষ্ম, জনক-জননী এঁদের দেখার জন্য উতলা হয়েছি আমি কিন্তু তাঁরা কেউ
অধমের জন্য ব্যস্ত নন বুঝি? এই বুঝি স্বর্গের নিয়ম?

দেবদূত :

স্বর্গের নিয়ম নেই কিছু
এখানে রাজা ও প্রজা ভেদ নেই, প্রহরীও নেই বাস্তব ও পরাবাস্তবতা কিছু নেই
শোষণ-শাসন নেই, তবু হানাহানি
নেই এ রাজত্বে, শুধু কল্পনার বাধাহীন লীলা
পাণ্ডুপুত্র, আপনার পিতা ও পিতৃব্য, সন্তানাদি যত
সকলেই অধীর অপেক্ষারত রয়েছেন
স্বয়ং সস্ত্রীক ইন্দ্র, অন্যান্য দেবতাবৃন্দ ব্যাকুল প্রতীক্ষা নিয়ে
আছেন নন্দনকাননের অন্য প্রান্তদেশে
সবাই জানেন আজ মহাত্মা কর্ণের অভিপ্রায়
তিনি এই সিংহদ্বারে সায়াহ্নবেলায়
প্রথম সাদর সম্ভাষণ জানাবেন দ্রৌপদীকে
কর্ণের সম্মানে তাই সকলেই কিছু দূরে সরে রয়েছেন
যুধিষ্ঠির :
দ্রৌপদী, আমার পত্নী, পুত্রের জননী….
দেবদূত :
দ্রুপদনন্দিনী, যাজ্ঞসেনী
পৃথিবীর শেষতম ধ্বংসের নায়িকা
কথঞ্চিৎ নরক দর্শন সেরে তিনি আসবেন অচিরেই
যুধিষ্ঠির :
বন্ধুর পার্বত্যপথে করেছি নিষ্ঠুর ভাবে যাকে পরিত্যাগ
যে আমার অত্যাগসহন
পঞ্চ পাণ্ডবের বক্ষমণি, সে আমার প্রাণাধিক
ত্রিলোকের সর্ব সুখ যার প্রাপ্য, সেই দ্রৌপদীকে
ভূমিশয্যা নিতে দেখে থামিনি একটুও, আমি
এমনই কঠিন।
এই নীতি নিষ্ঠা আজ তুচ্ছ মনে হয়
দেবদূত, আমি অনুতপ্ত, যেন সর্ব অঙ্গে সূচ
একটু দাঁড়াও, আমি পাণ্ডব বংশের
কুললক্ষ্মী, প্রতি মুহূর্তের স্মরণীয়া
দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে যাবো!
দেবদূত :
এ কী কথা বলছেন, যুধিষ্ঠির!
যুধিষ্ঠির :
অন্যায্য বলেছি কিছু দেবদূত?
দ্রৌপদী আমার পত্নী নয়? সে আমার
সঙ্গে যাবে, এটাই কি স্বতঃসিদ্ধ নয়?
দেবদূত :
ধর্মরাজ, আপনার অবিদিত কিছু নেই
এমনই ধারণা ছিল। তবে কেন এ হেন বিভ্রম?
স্বর্গে পৃথিবীর কেউ কারো স্বামী কিংবা জায়া নয়
কেউ ভ্রাতা ভগ্নী নয়, সন্তান বা জন্মদাতা-দাত্রী নয়
নর-জীবনের সব সংস্কার মুছে দিতে হয়
এ যে চির যৌবনের রাজ্য, এই বিমূর্ত ভুবনে
প্রাক্তন সম্পর্ক যেন ছায়ামূর্তি, ধরা-ছোঁওয়া যাবে না কিছুতে
কর্ণ আজ দ্রৌপদীকে চেয়েছেন, এখানে অন্যের উপস্থিতি
মান্যযোগ্য নয় কোনোক্রমে। শুধু দুর্যোধন রয়েছেন
কর্ণের বয়স্য তিনি, দ্রৌপদীর দ্বিতীয় প্রণয়ী
যুধিষ্ঠির :
আমার দক্ষিণ হাত অর্জুন কোথায়?
অর্জুন, অর্জুন!
দেবদূত :
অর্জুন আসেননি, কিছু দেরি আছে
ঐ তো আসছেন, এসে পড়েছেন শ্রীময়ী দ্রৌপদী
নরক পেরিয়ে আসা, অঙ্গে কোনো গ্লানি-চিহ্ন নেই
যুধিষ্ঠির :
দ্রৌপদী! দ্রৌপদী
[লঘু পায়ে স্বর্গদ্বার পার হলেন দ্রৌপদী। বহুবর্ণ প্রজাপতির মতন চঞ্চলা, স্বর্গে প্রবেশের জন্য ব্যস্ত। ছুটে নন্দনকাননের মধ্যে গিয়েও কর্ণ ও দুর্যোধনকে দেখে ফিরে দাঁড়ালেন।]
কর্ণ :
পাঞ্চালী, কেমন আছো? চিনতে পারো কি?
স্বয়ম্বর সভাস্থলে যেমনটি ছিলে, ঠিক
তেমনই রয়েছো তুমি।
দ্রৌপদী :
দানবীর কর্ণ? চিনবো না কেন? এই দিব্যকান্তি
কখনো কি ভুলে থাকা যায়?
তুমিও পূর্বেরই মতো অভিমানে অনন্য রয়েছো।
দুর্যোধন :
স্বাগত পাবক শিখা, দ্রুপদনন্দিনী
সামান্য নরকবাসে পাওনি তো তেমন যন্ত্রণা?
দ্রৌপদী :
ও কে, দুর্যোধন নয়?
পারত্রিক কুশল তো? না, না, আমি অত্যুত্তম আছি
নরক তেমন কিছু ভয়াবহ নয়, যে-রকম
রয়েছে রটনা।
নরকে সবাই বেশ লঘু ও আমোদপ্রিয়, খুবই সাবলীল
অনেকেই পরিচিত, কোনো অত্যাচার দেখিনি তো
এ যেন সবাই মিলে বনবাস, অচেনা ভুবনে।
চেনা মুখ সম্মিলন
দুর্যোধন :
এই স্বর্গে রয়েছেন কত দিব্যাঙ্গনা ও অপ্সরা
তবু তুমি, হে পাঞ্চালী, বিধাতার অপূর্ব নির্মাণ
তুমি এলে, স্বর্গ আরও আলোকিত হলো
দ্রৌপদী :
জানো নাকি এই স্বর্গ, এ আমার প্রাক্তন স্বদেশ
পৃথিবীতে অযযানিসম্ভূতা হয়ে কিছুদিন ভ্রমণে গিয়েছি
মানবলীলায় কিছু সুখ-শোক স্বাদ নেওয়া গেল
ফিরে এসে সব কিছু চেনা মনে হয়
পারিজাত পরিমলে সুস্নিগ্ধ বাতাস
এ ভূমির ধূলিকণা, প্রতিটি বৃক্ষের পাতা আমাকে চিনেছে।
[দ্রৌপদী ছুটে ছুটে গাছপালাদের আদর করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির কাতর ভাবে দূর থেকে দ্রৌপদীর নাম ধরে ডাকলেন, দ্রৌপদী শুনতে পেলেন না। বরং হাতছানি দিয়ে কর্ণকে ডাকলেন কাছে।
কর্ণ :
মানব জন্মের সব স্মৃতি তুমি অটুট এনেছো?
দ্রৌপদী :
সব নয়। তিক্ত-কটু কষায় কুৎসিত
স্মৃতিগুলি মুছে গেছে
স্মরণে রেখেছি শুধু মাধুর্য ও আনন্দের কথা
কর্ণ :
স্বয়ম্বর সভাগৃহে আমাকে কঠোর প্রত্যাখ্যান
করেছিলে, তাও মনে নেই?
তোমাকে প্রথম দেখা, সমস্ত দেখার শ্রেষ্ঠ দেখা
চকিতে মাথার মধ্যে শুরু হলো ঝড় ও অশনি
বিশ্ব চরাচর সব তুচ্ছ হয়ে গেল
চতুর্দিক অন্ধকার, যেন এক দ্বীপে শুধু তুমি
তুমি এক আলো দিয়ে গড়া মূর্তি, সত্য কিংবা মায়া
আমার চৈতন্যে শুরু হয়ে গেল তীব্র হাহাকার
মনে হলো, এক জন্মে আমার সমস্ত না-পাওয়ার
বিনিময়ে এই নারী, এ আমার, আর কারো নয়
লক্ষ্যভেদ অতি তুচ্ছ, প্রলয় সংহত করে আমি
এই বরবর্ণিনীকে পেতে চাই
আর তুমি? আমার যোগ্যতা আছে কি না তার
প্রমাণও নিলে না?
কটুবাক্যে ফেরালে আমাকে
দ্রৌপদী :
প্রত্যাখ্যান করিনি তো, যৎসামান্য কৌতুক করেছি
দুর্যোধন :
কৃষ্ণা, ভুলে গেলে, তুমি বলেছিলে, সূতজাতীয়কে
বরণ করবে না তুমি?
কর্ণ :
সামান্য মানবী নও তুমি, তবু তুচ্ছ জাত-পাত আর
বংশ পরিচয় মোহে ঢেকে নিলে মুখ।
ব্যর্থ হলো আমার পৌরুষ!
দ্রৌপদী :
ভেবেছি আঘাতে তুমি জ্বলে উঠবে দাবাগ্নির মতো
বীরশ্রেষ্ঠ, বাহুর দাপটে তুমি সকলকে প্রতিহত
করে দেবে, ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণকুল ভয়ে মূছা যাবে
সদর্পে হরণ করবে দয়িতাকে, আমি বীরভোগ্যা হবো।
কর্ণ :
সবলে নারীকে যারা পেতে চায়, তারা।
প্রকৃত পৌরুষহীন, তারা ধিক!
ক্ষুধার্ত পশুরা চায় মাংসের শরীর
নারী যেন কাব্য রস, সুখদা স্বয়মাগতা হলে
অন্তরের রূপ খোলে, সেই রূপ পূর্ণ হয় প্রেমে
লক্ষ্যভেদ সেরে আমি তোমার সম্মুখে
প্রণয় প্রত্যাশী হয়ে দুরু দুরু বক্ষে দাঁড়াতাম
দ্রৌপদী :
সুর্যপুত্র, সেদিন তোমাকে আমি নিমেষে চিনেছি
হাস্যমাখা ওষ্ঠ, চক্ষে ক্রোধ, তুমি চকিতে সূর্যের
দিকে চেয়েছিলে, মনে আছে, সব কথা মনে আছে!
সুর্যের সন্তান তুমি, প্রথম পাণ্ডব
আমার জন্মের গুঢ় মর্ম ছিল তোমার অজানা?
ধৃষ্টদ্যুম্ন আর আমি, যজ্ঞের আগুন থেকে জাত
বড় বেশি অগ্নি আর তেজে গড়া, হৃদয়েও জ্বলন্ত আগুন
দ্রোণ আর দ্রৌণপন্থীদের ভস্মসাৎ করে দেওয়াই তো
আমার নিয়তি
দ্রোণ তোমাকেও দিয়েছেন শুধু অবহেলা, তিক্ত অপমান
তোমাকে পেতাম যদি, কর্ণ, তবে যুদ্ধের অনল
সহজেই নিবে যেত, সপার্ষদ ধ্বংস হতো কপট ব্রাহ্মণ
আমার পিতার ক্ষুব্ধ আত্মা শান্তি পেত
কর্ণ :
এসব তো রাষ্ট্রনীতি, বংশের স্পর্ধার ইতিকথা
প্রণয়ের ব্যাকুলতা মহাকাল-ইতিহাস কিছুই মানে না
যাজ্ঞসেনী, তোমাকে চেয়েছি আমি
নিঃসঙ্গ এ হৃদয় জুড়োতে!
দ্রৌপদী :
তুমি ফিরে গেলে তাতে আমিও কি প্রত্যাখ্যাতা নই?
একটি বাক্যও তুমি বলোনি আমার দিকে চেয়ে
দুচক্ষু অন্যত্রগামী। তুমি দাতা, সেই অহঙ্কারে
অর্জুনের হাতে তুলে দিয়ে গেলে কাম্য রমণীকে।
কর্ণ, তবু সমস্ত জীবন আমি তোমাকে খুঁজেছি
ভেবেছি যে-কোনো দিন তুমি এসে দাঁড়াবে সহসা
কুন্তীর প্রথম পুত্র এবং আমার অগ্রগণ্য স্বামী হবে
শোনোনি কৃষ্ণের দৌত্যে আমার আহ্বান?
কর্ণ :
সে অনেক দেরি হয়ে গেছে
শুধুই জন্মের সূত্রে প্রণয়ের অংশভাগী হবো?
কৃষ্ণ বহুদর্শী, তবু তার সে প্রস্তাব হাস্যকর!
তোমাকে দ্বিতীয় দেখি, একবস্ত্রা, দূত ক্রীড়াপণ্যা, যেন দাসী
তৎক্ষণাৎ জ্বলে উঠি, নীচতা আক্রান্ত হয়ে আমি
তোমার উদ্দেশে বহু বিষময় কুকথা বলেছি
কিন্তু তা যে এক ব্যর্থ প্রণয়ীর গুঢ় আর্তনাদ
কেউ কি বোঝেনি? কৃষ্ণা, তুমিও বোঝোনি?
দুর্যোধন :
ফুরিত অধরা, কৃষ্ণা, এখনো রয়েছে ক্রোধ বুঝি?
দ্রৌপদী :
না, না, কোনো ক্রোধ নেই শুধু খেদ এই।
যখন নীরব ছিল নতমুখে মহা শক্তিধর পঞ্চপতি
আশা ছিল, তখন কর্ণকে পাবো পাশে
যে আমার প্রথম প্রণয়ী।
কর্ণ :
এখন তোমার পাশে, এত কাছে কখনো আসিনি
নীলোৎপল সৌরভমাখা বরতনু, এই সুচারুহাসিনী
নারী, তুমি, তুমি কি অলীক?
[দ্রৌপদী হাত বাড়িয়ে কর্ণের অঙ্গ স্পর্শ করলেন। দূরে যুধিষ্ঠিরের মুখ বেদনায় কুঞ্চিত হয়ে গেল।]
দ্রৌপদী :
কামনা বাসনাময়ী আমি এক নারী
আগুনে জন্মেছি তাই সর্ব অঙ্গে বড় বেশি জ্বালা
কর্ণ :
দ্রৌপদী!
যুধিষ্ঠির :
দ্রৌপদী!
[দ্রৌপদী এবার তাকালেন যুধিষ্ঠিরের দিকে। ঈষৎ ভূভঙ্গে হাসলেন। তারপর আবার ফিরলেন কর্ণের দিকে। দুর্যোধন একটু দূরে একটা শিলাখণ্ডে বসে পড়েছে।]
দ্রৌপদী :
চলো, সখা, মন্দাকিনী সলিলে শরীর ধুয়ে নিই
আমার শ্রবণ উষ্ণ, চক্ষু উষ্ণ, শিরায় শিরায় দাবদাহ
আমার শৈশব নেই, তাই স্নেহ-মমতা জানি না
দেখিনি জননী ক্রোড়, তাই ঠিক মাতা হতে পারিনি কখনো
পায়ের আঙুল থেকে কেশাগ্র পর্যন্ত যৌবনের আঁচ
আমি এরকম ভাবে গড়া
সেই আঁচ কিছুটা ভাসিয়ে দেবো স্বৰ্গনদী স্রোতে
কর্ণ :
নদীকে যা দেবে তুমি, তা আমায় দাও।
আমি প্রার্থী, আমি ধন্য হবো।
দ্রৌপদী :
তুমি সুর্যপুত্র, তুমি আর কত আঁচ নিতে পারো?
কর্ণ :
এই নদী যত পারে, তার চেয়ে বেশি!
[দ্রৌপদী ততক্ষণে দৌড়ে চলে এসেছেন মন্দাকিনী তীরে। কর্ণ তার পাশে এসে দাঁড়াতেই দ্রৌপদী তাঁর দিকে জল ছুঁড়ে দিলেন। তারপর দুজনেই খেলার কৌতুকে, নির্মল হাসিতে ভরিয়ে দিলেন দশ দিক।]
দেবদূত :
এ কী ধর্মরাজ, আপনি অনড় প্রস্তরবৎ কেন
সম্মুখে চলুন, অতি বিশিষ্টরা প্রতীক্ষা-ব্যাকুল
ঢের দেরি হয়ে গেছে
পূর্বেই বলেছি, এই দৃশ্যখানি
আপনার না দেখাই ভালো ছিল, সুশোভন ছিল।
যুধিষ্ঠির :
দেবদূত, আমি আর স্বর্গ অভিলাষী নই
ফিতে যেতে চাই
দেবদূত :
এ কী অসম্ভব কথা। স্বর্গরাজ্য জয় করেছেন
সেই দার্ঢ্য, সেই কীর্তি, তার পুরস্কার চির স্বর্গসুখ
যুধিষ্ঠির :
স্বর্গে কোনো স্বর্গসুখ নেই। সেই স্বপ্ন
আছে শুধু পৃথিবীতে। হায়, সব মিথ্যে হয়ে গেল।
হে সুভদ্র, আমাকে ফেরার পথ বলে দাও, কোন্ দিকে যাবে?
দেবদূত :
সশরীরে স্বর্গে তবু আসা যায়, ফেরে না তো কেউ
যুধিষ্ঠির :
দ্রৌপদী, দ্রৌপদী!
দেবদূত :
এ কী যুধিষ্ঠির, আপনার চোখে জল
ছি ছি, এই পুণ্যক্ষেত্রে ক্রন্দন করে না কেউ, দেখিনি কখনো
অশ্রুবিন্দু এখানে অচেনা, সে তত মত, পৃথিবীর
লঘু দুর্বলতা
যুধিষ্ঠির :
আমিও তো পৃথিবীর, আমিও মানুষ
হিংসা-ঈর্ষা-মোহ-মায়া সব কিছু মিলিয়ে মানুষ
ক্রোধ আছে, কান্না আছে, শরীরী নিয়ম সবই আছে
দেবদূত :
ইন্দ্রের প্রসাদে
অচিরেই ইহলোক-চিহ্ন মুছে গিয়ে
দেবত্বে উন্নীত হয়ে অতি জ্যোর্তিময় কান্তি হবে আপনার
যুধিষ্ঠির : দেবত্ব চাই না আমি, আমাকে মানুষ থাকতে দাও
আমাকে মানুষ হয়ে বাঁচতে দাও।
মানুষ, মানুষ!
[অদূরে কর্ণ ও দ্রৌপদীর জল খেলা ও প্রমোদের হাসি চলতেই থাকে। তার মাঝে মাঝে শুনতে পাওয়া যায় যুধিষ্ঠিরের কান্নার
 

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ