বৃদ্ধার মৃত্যু

সুনন্দা মাকে বহুদিন দেখেনি, কথাও হয়নি, সারাদিন কাজের ফাঁকে মাকে একবার অন্তত ফোন করে, কিন্তু কদিন আগে ফোনটা জলে পড়ে গেল, বাড়িতে এই একটাই ফোন কোন রকমে চলে, তার ওপর মায়ের ফোনটাও চালাতে হয়, দুতিনটে ফোন চালানোর জন্য সমর্থ নেই তাদের, স্বামী একটা ছোটো দোকান চালায় পান বিড়ি সিগারেটের, সুনন্দারা দুই ভাই বোন, স্কুলে পড়তে পড়তে প্রেম করে পালিয়ে এসেছিল সে, বাবা মারা যাওয়ার পর বাপের বাড়িতে খুব একটা আদর পায়নি সুনন্দা, বাপের বাড়ি যে খুব একটা অচল তা নয়, তাদের নিজের বাড়ি বনগাঁও শহরে, ইটের ভাটার মালিক ছিল তার বাবা, বর্তমানে দাদা চালায়, দাদার বিয়ের পর বৌদি তার পালিয়ে যাওয়াটাকে কেন্দ্র করে ঝামেলাও করেছে, সম্পত্তি নিয়ে, যেহেতু সুনন্দার বাবা তাদের বিয়েটা স্বীকৃতি দিয়ে যায় নি, দিয়েছিল কিনা মরণকালে তাও জানতে পারেনি সুনন্দা, তবু মায়ের কাছে তার অন্যায় সে স্বীকার করেছে, মা তাকে মেনে নিলেও দাদা বৌদি মানেনি। কেন মানেনি সুনন্দা জানে, তার স্বামীও জানে, কষ্টে থাকলেও কোনোদিন দাদা বৌদির কাছে হাত পাতে নি, দাদার দুইমেয়ে, বেশ বড় হয়েছে, পিসি বলে তারা জানে কিনা সন্ধেহ আছে, এই রকম অবস্থায় বাপের বাড়িতে গিয়ে মায়ের খোঁজ নেওয়া খুবই কঠিন, তবু একবার যাবে মায়ের খোঁজ নিয়েই চলে আসবে সে, এই ভেবে সকালে স্বামীর হাতটা ধরে আদর করে বলল,
-যাই না গো একবার মাকে দেখে আসি,
স্বামী গররাজি হওয়া সত্যেও সে রওনা দিলো বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
ট্রেন একটা বাস তারপর রিস্কা ভ্যানে আধ ঘন্টা পথ, রাস্তার মুখে বাড়ি দোতালা, নিচে একটা ছোট্ট ঘরে মায়ের বাস, পেছনের দিকে, সিঁড়ি ঘরের পাশে, লুকিয়ে ঘরে ঢুকে মায়ের সাথে কথা বলেই চলে যাবে ভেবেছিল, কিন্তু কেমন যেন নিঃস্তব্ধ সব, থমথম করছে, কেউ কোথাও নেই, মায়ের বিছানাটাও এলোমেলো, সাধারণত মা তার বিছানাটা বেশ টিপটাপ করে রাখে, মা কি নেই এখানে, দাদা কি মাকে তাড়িয়ে দিলো? আগে দেখেছে দাদা বৌদি মায়ের ওপর কত অত্যাচার করেছে, মাকে খেতে দেয়নি, ঘরে ঘুমাতে দেয়নি, যে ঘরটায় মা এখন থাকে, সেটা মা অত্যাচারের জ্বালায় বেছে নিয়েছে, মায়ের যে ঘরটা ছিল, দক্ষিন মুখো সেটা নাকি বড় নাতনিকে দিয়েছে, মাকে সুনন্দা অনেক বলেছে,
-চলো না মা আমার কাছে, যাই হোক নুন ভাত খেয়ে থাকবো, 
-না রে মা আমি মরার আগে এ বাড়ি ছেড়ে যাব না,এবাড়িতে তোর বাবার স্মৃতি জড়িয়ে আছে, তাকে আমি কথা দিয়েছি। কি করে একটা মৃত্যু মুখি লোকের কথার খেলাপ করতে পারি।
মায়ের এই উত্তরে আর কোনো কথা বলতে পারেনি সুনন্দা, তখনই মাকে ফোনটা কিনে দিয়েছিল ইন্সটলমেন্টে, মাঝে মাঝে ভিডিও কল করে মাকে দেখতো, কথা বলতো। 
আজ মায়ের কাছে এসেও মায়ের দেখা পাচ্ছে না, ঘরে ঢুকতেই কেমন কেমন মনে হচ্ছে সুনন্দার। মায়ের ঘরের উল্টো দিকে একটা বুড়িমা থাকেন পাশের বাড়ির, তার কাছে সুনন্দা চুপিচুপি জিগেশ করলো, 
-ও কাকিমা মা কই গো?
-সুনু তুই এসেছিস্?
সুনন্দার ডাক নাম সুনু।
- হ্যাঁ কাকিমা, তুমি জানো মা কোথায়?
- বেশ কদিন দেখিনি তো রে মা, একদিন বেশ ঝগড়া ঝাটি শুনছিলাম কি একটা মোবাইল চার্যার নিয়ে, তারপর থেকে আর দেখিনি মনে হয়, তুইতো জানিস তোর বৌদিকে, কি আবার বলে বসবে, তাই ইদানীং কথাও বলতাম না, জিগেশ করে দেখনা।
- না গো কাকিমা, ওকে বলে এসেছি মাকে দেখেই চলে আসব, ওদের সঙ্গে এখন কথা বলতে গেলে, কাগজ পত্র নিয়ে বসবে, এখানে সই কর ওখানে সই কর, ভালো লাগে না কাকিমা, আমি বরং চলে যাই তুমি একটু বলে দেবে, আমি এসেছিলাম, হয়তো বাজার টাজার করতে গেছে।
সুনন্দা ফেরার পথ ধরলো, একটা ভ্যান আসছে দেখে তাকে জিগেশ করলো বাস স্ট্যান্ড যাবে কিনা? 
- যাবো...আরে সুনুমা কখন এলি?
আমাকে চিনতে পারলেও আমি চিনতে পারিনি গৌরকাকাকে, আমাকে প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যেত, খুব ভালো মানুষ, শরীর ভেঙেছে, গাল তুবড়ে গেছে, কিন্তু মনের মধ্যে সেই তখনকার উদ্দিপনা এখনো দেখতে পেলাম।
-কাকা, তুমি এখনো ভ্যান টানো? 
- হ্যাঁ রে মা, একবার ভেবেছিলাম তোর দাদার ইট খোলায় কাজ করি, কিন্তু হলো না, সে যাক তুই এখানে? 
- কাকা মাকে দেখেছ বাজারের দিকে?
- মা! বাজারে? কই নাতো, তোর মাকে তো দেখিনি অনেকদিন, মাঝে শুনেছিলাম কি একটা ঝামেলা হয়েছিল, তারপর আর কিছু জানি না। তবে এখন বাইরে বেরতেন ও না। মন খারাপ করিস না, দেখ এদিক ওদিক কোথাও আছে।
গৌরকাকা চলে গেল, সুনন্দাকে বললও না পৌঁছে দি কি, যাবে নাকি, বড় অদ্ভুত ভাবে কাকা নিজেকে এড়িয়ে গেল, এমন কি হতে পারে যে সুনন্দার সঙ্গে এমন ব্যবহার করছে সকলে। হয়তো তাকে পৌঁছে দিলে, দাদা কাকাকে ভৎসনা করবে। শুনেছে দাদা টাকার জোরে শহরের মেয়র হয়েছে। কিন্তু বাড়ির গেটেও কাউকে দেখলো না, 
যদিও দাদা বৌদিকে সে চেনে, হয়তো কেউ তার দাদার বাড়িতে কাজ করতে চায় না, কিন্তু দাদার যারা ধামাধারি তারাই বা গেল কোথায়? কারোর সঙ্গে ভালো তেমন ব্যবহার নেই ঠিকই , তা বলে শহরের মেয়র, তার বাড়িতে কোনো সিকিউরিটি থাকবে না।
 আগে দেখেছে বাবার কাছে কত লোক এসেছে, বাইরের ঘরে আড্ডা হয়েছে, স্কুলের হেড মাস্টার সমেত কত গুণী জ্ঞানীজন এসেছে বাড়িতে, এখন......।

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

রবীন্দ্রনাথের প্রতি সুকান্ত