নজরুল

সোমনাথ বসু

* ১৯৩০ সাল। মে মাসের তারিখ বুধবারা প্রচণ্ড গরম। সকাল থেকেই গাছের পাতা স্তন। কলকাতার আকাশে- বাতাস সোমন যেন গুমোট হয়ে আছে। এন্টালির ৮/১ পালবাগান লেনের বাড়িতে আনচান করছেন কবি। বসন্ত রোগে আক্রান্ত ছেলে বুলবুলো শরীরটা বেশ খারাপ। ডাক্তার, কবিরাজ, বদিকোনও কিছুই বাদ রাখেননি তিনি। কিন্তু ক্রমশই মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ছে বহুলা আটকের বুলবুল। বিকেলের দিকে একরাম বললেন, "দমদমের কাছে এক সাধু থাকেন। বসন্তে আক্রান্ত রোগীদের তিনি করে তুলছেন। দেরি না করেই কবি সেখানে পাঠালেন মুখ সঙ্গী মইনুদ্দিন ও শাপিন সিংহকে। কাতর কণ্ঠে আবেদন তাঁর, যে করেই হোক একবার তাঁকে নিয়ে । ন এলেন, তবে তখন রাত অনেক হয়েছে। শান্তিদের ডাক শুনে দৌড়ে এলেনা করি। নরমালেই মইনুদ্দিনের কধি তোরা সাধু কি মরদেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারে। একবার ন্যা, দু'বার নয়। বারবার একই কথা বলে চলেছেন কবি। বাকিরা বিহুল। সাধু আসার মিনিট দশেক আগেই বুলবুলের মৃত্যু হয়। পাতাবিকভাবেই এরপর ভেঙে পড়েন। নজরুল। খাওয়া নেই, দাওয়া নেই, পুত্রশোক কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। এর ঠিক মাস তিনেক পরে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় মুর্শিদাবাদের লালগোলা বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার বরদাচরণ মজুমদারের সঙ্গে। তিনি তন্ত্রসাধক, কালীতও বটে। এই পর্বেই ক্রমশ মা কালীর শুরু হয়ে পড়েন নজরুল। অসুস্থ বা প্রমীলা কাজির জন্য কলকাতার একাধিক মন্দির থেকে তিনি প্রসাদী ফুল সংগ্রহ করেছেন।। জানা যায়, সাহিত্যিক অব্যশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নজরুলের আলোচনার সিংহভাগ জুড়ে থাকত সাধনা।

তিনের দশকের প্রথম দিকে নাফরুলের ভালোবাসার বৃত্তে ঢুকে পড়ে রামপ্রসাদের শ্যামাসঙ্গীত। আপন খেয়ালে তিনি তুলে নেন অপার সংসার, নাহি পারাবার' এবং মনরে, কৃষিকাজ জানো না। বরদাচরণই কবিকে এই সময় রামপ্রসাদের একটি বই উপহার দেন। তা পরে কালী সাধনার প্রতি তাঁর আকর্ষণ আরও বাড়ে। লিখতে শুরু করেন।

শোনা যায়, ভোররাতের স্বপ্নে মা কালীকে কনালাপে দেখেন নজরুল। তারপরই ভেঙে ঘুম। পড়পড় করে উঠে বলেন কবি। কিছুক্ষন ভাবনাহিস্তার পর মিলেমিশে একাকার কালি, কলন, মন। গানটি কী জানেন মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা 'আগে নাচন। খুব ভালো করে গানটি পড়লে বা

আবেগের সঙ্গে কবির ভরি ভারসাম্য প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একইরকম। এই গানেই তিনি লিখেছেন, মেয়ে এলোকেশী নিশীথিনীর দুলিয়ে বেশ, নেচে বেড়া দিনের চিতার লীলার যে তার নাইকো শেষ/ সিন্ধুতে মা'র বিন্দুমানিক ঠিকরে পড়ে রূপের মানিক, বিশ্বে মায়ের রূপ ধরে না. মা আমার তাই লিগ-বসন"। অর্থাৎ, মায়ের কন্যা

শ্যামাসঙ্গীতের পূজারি 
ইসলামের জীবনের দরজায় বারবার কড়া নেড়েছে তবে পড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন কবি। বিভিন্ন সমালোচনা গাছে না মেখে পথে এলানোই ছিল তাঁর দর্শন। খ্যাতির দৌড়ে নিজেকে রাখতে ডাননি কখনও। সাবের বাংলাদেশের বেতারেও একসময় তাঁর শ্যামাসঙ্গীত নিষিদ্ধ হয়েছিল। একবুক অভিমান নিয়ে মনিষ্ঠদের বলতেন, 'জানি, আমার শ্যামাসঙ্গীত নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে। কিন্তু নিজেকে বদলাতে পারি না। পয়সাওয়ালাদের তাবেদারি করা স্বভাবে নেই)। রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে নিয়েই জীবন আমার। অসাধারণ হওয়ার জন্য সাধারণকে ভোলা অ

বিশেষজ্ঞরা বলেন, নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত প্রধানত তিন ধরনের। প্রথম পর্বে কন্যা এবং মাতৃরূপে মা কালীকে তিনি শব্দ ও সুরের সংমিশ্রণে পুজো করেছেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কবির মনে হয়েছে, না অশুভনাশিনীও বটে।

হালিশহরের সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের পর নামলেই একমাত্র বাকি, যিনি ২০৭টি শ্যামাসঙ্গীত লিখেছিলেন। আর তাঁর খানের ইউএসপি। ভাব ও ভাষার সহজ থাকা। তাই তো তাঁর কলন দিয়েই বেরিয়েছে, 'মোর লেখাপড়া হ'ল না মা, আমি 'ম' দেখিতেই দেখি শ্যামা।। আমি 'ক' দেখতেই কালী ব'লে নাচি দিয়ে করতালি।"

এবং মাতৃরূপকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন অনবদ্য শব্দবন্ধে। দর্শন এবং তত্ত্বের বেড়া ভেঙে মা কালী প্রতিভাত হয়েছেন শুধুমাত্র তাঁর চেতনায়।

জীবনের মাঝপথে প্রায়শই ভক্তিভাবে উলমল করতেন করি। পদস্খলনের আশা ভুলিয়ে তাকে সহযোগিতার দু'হাত বাড়িয়ে দেয় কালী সাধনা। এমনই এক সন্ধ্যায় 'মা' মা' বলতে বলতে আক্রোশে লিখে ফেলেন, ভক্তি, আমার সুমের মত, উর্জে ওঠে অবিরত / শিব-লোকে দেব- শ্রীচরণ পরশিতে।"

পরাধীন ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য নাজরুল কলম ধরেছিলেন। এই পর্বেও মা কালী তাঁর সৃষ্টিতে বারবার এসেছেন। মহাশক্তির কাছে কবি দীনতা ভীরুতা লাক মানি' ঘোচানোর মধু চেয়েছেন। এই সময় তাঁর একাধিক শ্যামাসঙ্গীতে সমকালীন নিপীড়িত ভারতের। ছবিও ফুটে উঠেছে। অসুর বিনাশিনী মা কালীর কাছে শক্তি ভিক্ষা করে তিনি দেশবাসীকে দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হতে বলেছেন। এক সাক্ষাৎকারে নজরুলের মস্তবা 'এক মায়ের কাছে আরেক মানের ধীনতা শিক্ষার মধ্যে বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই। এটা তো জীবনের তাগিদ। দেশ স্বাধীন হলে আমাদের চেতনা ও মুক্ত হবে। কতদিন আর কারাগারের শিকলে মাকে বন্দিদশায় দেখব?”

জীবনের গোধূলি বুলবুলকে ভুলতে পারেননি কবি। কখনও মনে হয়েছে, কোপাই হয়তো ছেলের সঙ্গে তাঁর দেখা করিয়ে দেবেন। এরকম ভাবনা থেকেই তিনি একদিন লিখে ফেললেন, 'এই শ্মশানে ঘুমিয়ে আছে। যে ছিল মোর বুকের কাছে,/ সে হয়ত আবার উঠবে জেগে মা ভবানী


Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ