কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ

কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ
দেবপ্রসাদ

কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ
দেবপ্রসাদ


কুন্তী - কেন করো প্রত্যাখান, জ্যেষ্ঠ পুত্র মোর  
          এই সন্ধ্যাকালে পুণ্য জাহ্নবীর তীরে
           ছাড়িয়া সকল লাজ, পাণ্ডব জননী, 
          এসেছে তোমার দ্বারে, ভিক্ষা পাত্র হাতে।
          রাধা গর্ভজাত নও তুমি , মহাবীর ,
          কুমারী কালের ভুল , হে জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব। 
         হে কর্ণ কনিষ্ঠ ভ্রাতা, তব অপেক্ষায়- 
          যুদ্ধের পরিণতির কথা তুমি জানো।
          রাজ্য পাবে, পাবে মহাবীর পাঁচ ভ্রাতা।
          তব ছত্র ছায়া তলে, সুরক্ষিত হবে।
         স্নেহসিক্ত ছায়া তলে,মাতৃস্নেহে রাখি  
         হে সূর্য তনয়, কথা দাও মোরে তুমি-
          এই জাহ্নবীর তীরে, কুরুক্ষেত্র রণে,
          পাণ্ডবের পক্ষে হবে, লবে যুদ্ধ ভার।

কর্ণ-   হে সুচির-প্রতীক্ষিত,  জননী আমার-
          মাতৃস্নেহের-বুভুক্ষু, সন্তানকে ডাকো,
          জ্যেষ্ঠ কৌন্তেয়ের, জ্যেষ্ঠ পদ মর্যাদায়, 
          আপন মাতৃস্নেহের আশ্রয়ে, হে মাতঃ
         একে স্বীকার করার, সুপ্ত অভিলাষ -
          মোর গোপন হৃদয়ে, লালসার বীজ, 
          অঙ্কুরিত হয় এই, সন্ধ্যাসবিতায়।
          সত্যই তো,পাণ্ডবের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আমি,
          অনুজ পাণ্ডবদের, ঊর্ধ্বে স্থান হত। 
          এ গৌরব অস্বীকার, করলে কোথাও
          সত্যের নিকটে আমি, মহাবীর কর্ণ,
          দীর্ঘ-সঞ্চিত ব্যথায়, আর অভিমানে,
          আঁখি ফুঁড়ে বান আসে, শুষ্ক নদীকুলে।
          কি হবে দুর্যোধনের, প্রিয় বন্ধু মোর।

কুন্তী- কেন করো অধমের মতো ঘৃণ্যকাজ?
          কুন্তী পুত্র তুমি, হেন কাজ নাহি সাজে
          বিধাতার করাঘাতে আছো পরবাসে 
          ফিরে এসো মাতৃক্রোড়ে, আছি অপেক্ষায় 
          এ যুদ্ধের প্রয়োজন নাই, চলে যাই
          কোনো অজানার দেশে, ভরি আত্মসুখ
          কর্ণার্জুন যুধিষ্ঠির, ভীম সহদেব,
          নকুল কনিষ্ঠ তব, বড় আদরের
          দ্বাদশ বছর কাল বনবাসে রই
          চক্রান্তের বেড়াজালে, তেরটি বছর
          ভ্রাতা শকুনির জালে, পাশার ভেলকি
         বারে বারে অনাচার, অবিচারে বলি
         হয়েছে পাণ্ডব, তবু ক্রুর নরাধম 
         ক্ষান্ত হয়নি এখনো, অশান্ত কৌরব।

কর্ণ-   কি জানি কি অভিলাষে, এসেছেন হেথা
          আপন পুত্রের ন্যায় আঁচল আদরে 
         স্নেহের আঁচল খানি দিয়েছ বিছায়ে।
         কোন আসনে বসাব অর্জুন জননী,
          এই জাহ্নবীর তীরে, কাদা মাখা ঘাটে।
          সূতপুত্র আমি মাতঃ, পিতা অধিরথ।
          আশৈশবকাল আমি যে স্নেহসিক্তের 
          আশ্রয়ে লালিত, তার অমর্যাদা করা-
          অসম্ভব, এই  পুণ্য জাহ্নবীর তীরে-
         একান্তে, গর্ভধারণী, ক্ষমা করো মোরে,
         মোর পক্ষে তা কি, সত্যি মানবিক হবে?
         সূর্যের সন্তান আমি, কুন্তী গর্ভজাত।
         পাণ্ডবকুলের জ্যেষ্ঠ, মহাবীর কর্ণ।
         কি সংবাদ যাবে মাতঃ, দূর ভবিষ্যতে?

কুন্তী-   একি কথা কহ পুত্র, এই সন্ধ্যাকালে
           এই জাহ্নবীর তীরে, নিতান্ত নির্জনে
           পাণ্ডব জননী আমি, এসেছি একান্তে।
            আলুলায়িত অবলা, অসংযত নারী,
            রিক্ত আঁচলের নিচে, ভিক্ষা পাত্র হাতে
            শূণ্য পাত্র মোর  দ্বন্দ্ব, বোঝে না কোন্দল
           শুধু মাতৃস্নেহ বোঝে, বোঝে ভালোবাসা 
            তারে কেন বিতাড়িত করো অনায়াসে।
            পরভৃত কাকপুষ্ট, আছো পরবাসে, 
            বীর পঞ্চপুত্র মোর, শাস্ত্রজ্ঞ ঋত্বিক,
            ওহে পুত্র কিছুক্ষণ অপেক্ষায় থাকো
            দেব দিবাকর আজ, যাক অস্তাচলে
            সন্ধ্যার পরে আঁধারে ছেয়ে যাক পৃথ্বী
            কহি ওরে, কৃষ্ণময় এই কুরুক্ষেত্রে-

কর্ণ-    মোর বিদ্রোহী মনের অন্তরালে আজ
           মাতৃ স্নেহের আকন্ঠ ভালোবাসা দিয়ে
           কি পেতে চান আদৃত, পাণ্ডব জননী 
           রণ সাজে কুরুক্ষেত্র, পাণ্ডব কৌরব
           চতুরঙ্গ সেনা লয়ে করিয়াছে যাত্রা
           সৈনের প্রধান কহে গৌরবে উছলি
           অদূরে শুনেছি হর হর মহাদেব
           ধনু হস্তে হাসে ওই বীর সেনাগণ।
           আর বেশি দেরি নেই ধনু আস্ফালন 
           কবচ কুণ্ডল বক্ষে করে ঝলমল
           রাতের আঁধারে দেখি, লক্ষ মৃতদেহ।
           এমন সময়ে কেন, আসিলে জননী
           নাহি জানি কত ব্যথা বুকে বয়ে নিয়ে
          এসেছেন মোর দ্বারে ভিক্ষা পাত্র লয়ে।

কুন্তী-   কুন্তী আমি, ভীত চিত্ত বিগলিত মোর,                     নগর রক্ষক এর মতো রক্ষা করি
           ভাগ্যকরাঘাত হতে আপন সন্তানে।
           শৈলতুষারের মতো, তব কণ্ঠস্বর
           মম হৃদয়ের চার চারটি প্রকোষ্ঠে 
           রক্তস্রোত বহে তব, অলীক বচনে
           জন্ম তব সূর্য তেজে, সূর্যের প্রতাপ
           কবচ কুণ্ডল বুকে করে ঝলমল
           অশনি সংকেত শুনি সদা কর্ণে মোর
           তমিস্রা রজনী মোর, কাটিবে কেমনে?
          হে মোর নভোমণ্ডল, মোর গর্ভজাত -
          কেন বোঝো না? যে অগ্নি মনের গভীরে
          জ্বলিছে প্রত্যহ, এই রুঢ় প্রত্যাখ্যানে 
          আরো আরো উদ্দীপিত, বড় জ্বালাময়।

কর্ণ-  কেন শুধু দুঃখ পাও, কেন জ্বলে মন?
         দুধের শিশু এক সে বোঝেনি জননী,
         ডাকেনি জননী বলে, বোঝেনি পৃথিবী।
         তবু তারে নদী বক্ষে, কার পাহারায়?
         ভাসিয়েছিলে জননী? হতবাক আমি,
         নদী বক্ষে কুম্ভীরের আদৃত আহার,
        বোঝোনি তাই না, মাতঃ, অর্জুনজননী!
        কারে করো দোষী মাগো, কারে করো ভাগি
        হ্যাঁ হ্যাঁ অর্জুনজননী বটে, মহীয়ষী নারী, 
        আজো মনে পড়ে সেই, সূতপুত্র বলে
        অস্ত্রশিক্ষা নিতে দ্বারে দ্বারে ফিরিয়াছি 
        হস্তিনানগরে, ব্যর্থ পথিকের ন্যায়।
        যদি মোর মাতা হতে, এ ব্যথা কেমনে 
        সহিতে বলতো মাতঃ, ঘৃণা  অপমান।

কুন্তী-  বিধাতার ভয়ানক, এক পরিহাস।
          মাতৃস্নেহের অতৃপ্ত ক্ষুধা, অভিপ্রায়
          সহস্র নাগিনী যেন, দ্বেষ লালসায়
          বাক্যহীনা করেছিল যে অভাগিনীরে,
          সেই আমি মহারানী কুন্তী, হস্তিনায়।
          স্বপনে দেখেছি যারে, সূর্য-কুন্তী পুত্র
          দেখেছি নিঃসঙ্গে ঘন, জীমূত আড়ালে-
          অগাধ ভালোবাসায় বুকে, অভ্যন্তরে।
          আঁধার রাতে কৌমুদী, সহস্র নক্ষত্র
          যবে চপলা চঞ্চলা হয়ে যায় মনে,
          দ্বাদশ বছর ধরে, গহীন অরণ্যে
         বুঝেছে জর্জর বক্ষ, শূন্য অবকাশে।
         লোকনিন্দা কুৎসাভয়, রাজকন্যা আমি 
         কি হবে যশোমণ্ডিত খ্যাতি গৌরবের।
     
কর্ণ-  দ্রৌপদীর সয়ম্বরে কহিল দ্রৌপদী
        রাজকুলে জন্ম নহে কোন অধিকারে
        এসেছেন সয়ম্বরে, বসি সিংহাসনে,
        অগ্নিসম তেজে এই রাজসভা মাঝে।
        ক্রূর হাস্যে করেছিল ব্যঙ্গ অপমান,
        পাণ্ডবের বন্ধু সবে সূত পুত্র বলে।
        জ্বালিল অগ্নির জ্বালা, এই বক্ষস্থলে।
        আরক্ত আনত মুখে না আসিল বাণী,
        দাঁড়ায়ে থেকেছি, সেই জ্বালাময়ী স্থলে,
        তখনো কাঁদেনি তব, দুখের অন্তর 
        মাতৃস্নেহের পিঞ্জর, কে সে অভাগিনী। 
        অর্জুনজননী, সে যে পাণ্ডুর ঘরনী।
        দুই নেত্র হতে ঝরে যার অশ্রুবারি
       সে নহে মাতা মোর, সে পাণ্ডব জননী।

কুন্তী- একি কহ পুত্র মোর ! মাতা নহি তব?
         সকাল বিকাল সন্ধ্যা যার পূজা করো,
         তার কাছে প্রশ্ন করো একবার তুমি
         কে আমি কে তব পিতা, মহাবীর কর্ণ
         লাজ লজ্জা সব ত্যাগ করে, সন্ধ্যাকালে
         এই জাহ্নবীর তীরে, আপন সন্তানে
         সত্য মিথ্যার বচনে,সে দোদুল্যমান।
         হা ঈশ্বর একি রূঢ় দোলাচলে আমি?
        হে জাহ্নবীর হিল্লোল, হে পবনরাজ
        নিয়ে চলো মোরে আজ, আপনার সনে
        জীবিতাবস্থায় যেন, পুত্রের মরণ
        দেখতে না হয়, বলো, বলো দিবাকর
        আমি সত্যি, না কপট, করেছি ছলনা?
        পুত্র তব অবিশ্বাসে, করে প্রত্যাখ্যান।

কর্ণ- এই পার্থিব তামাসা টুকু কেন মাতঃ?
        জানি, জানি আমি মাতঃ, অবাঞ্ছিত পুত্র
        তব, কহে শোনো মাগো, এই কুরুক্ষেত্রে
        মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে, শ্রীকৃষ্ণের প্রীতি-
        অচেনা কঠিন স্বরে, চির অস্তমিত 
        সূর্য এসে আচম্বিতে কেন বলে যায়?
        রাধা পুত্র রাধেয়র, সমাধিস্থ জন্ম 
        ইতিহাস, কেন, কেন বলে গেল মাগো? 
        একি শুধুই রক্তের টান? যে ঘৃণার 
        পুঁজি নিয়ে দুইবেলা, পাণ্ডু পুত্র হতে
        অধিক ধনী ভেবেছি তাও আজ কেন
        নিঃশব্দে হরণ করে, ভিখারী করিলে?
        বোধের জোছনা মেখে, কেন এলে, মাগো
        মমতার হাত খানি প্রসারিত করে?

কুন্তী- ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করো, হে জ্যেষ্ঠ কৌন্তেয়
         নীতিমর্যাদায় তুমি,  মহাবীর রথী 
         দানবীর ঋষি, এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
         যুধিষ্ঠিরের মতন, নিষ্ঠাবান তুমি।
         শক্তি প্রদর্শনে ভীম, বুদ্ধিতে অর্জুন
         সৌন্দর্যে নকুল, আর গুণে সহদেব
         কিসে কম তুমি বৎস, মহাবীর কর্ণ।
        ক্রোধ বিদ্বেষের ডালি, মনের গভীরে
        বিধাতা দিয়েছে ঢালি, সব তার খেলা।
        দেখে মনে মনে আমি, পরমাদ গণি।
        সন্ধ্যাকালে একাকিনী অবলা রমনী
        কোন অভিলাষে কাঁদে, নয়নের জলে
        বোঝনি কি ভালোবাসা? মমতার ভাষা
        মমতার আবরণে, পেতেছি আঁচল।

কর্ণ- মমতার আবরণ, ইতিহাস জানে,
       নক্ষত্রের কাছে আছে, প্রমাণ অনেক
       কি জানি কখন তার, হলো উন্মোচন।
       কর্ণের কপালে নামে, বারি ধারা হয়ে
      ভিক্ষা পাত্র লয়ে, মাতা আছেন দাঁড়িয়ে 
      দানবীর কর্ণ দেবে, তার পাত্র ভরে।
      অর্জুন ছাড়া যে, আরো চার সহদর
     মোর হাতে মৃত্যু নাই, কহিলাম আমি
     এর বেশি ক্ষতি আমি, করিব না মাতঃ
     ধনঞ্জয় নয় আমি, কোন একজন-
     এ যুদ্ধের বলিদান, হবে জেনে রেখো
     তাও তব পাঁচ পুত্র, রবে বিদ্যমান 
     প্রতিজ্ঞাপালন হবে, মহা যুদ্ধক্ষেত্রে
     যাও মাগো কথা দেই, এইটুকু জেনো।

কুন্তী- কার সাধ্য আছে বলো, বধিবে তোমারে
         কবচ কুণ্ডল আছে, বুকের উপর
         রক্ষ যক্ষ দেবকুল, সকলে বিফল
         একা কর্ণ মহাবীর, রক্ষিবে কৌরবে।
         সম্মুখ সমরে তুমি, বীর শিরোমনি
         তোমার প্রতাপে কাঁপে, বালক পাণ্ডব
         মরিবে একটি পুত্র, ধরিব হৃদয়ে
         দুই বাহু প্রসারিয়া, ক্রোড়ে করি নেবো
         কহিব রে পুত্র মোর, বুক জুড়ে থাক
         করিব চুম্বন তার, শ্রী চন্দ্রবদনে।
         জলন্ত আগুনে তারে, কেমনে ফেলিব
         সেযে প্রিয় পুত্র মোর, হৃদয়ের নিধি। 
         আর কেন দেহভার বয়ে লয়ে যাবো
         বিষাক্ত বিষের বাটি, কণ্ঠে ঢেলে নেবো।

কর্ণ-  যত কষ্ট পাও মাতা, বেশি মোরে দাও
        বৃথা এ সন্তাপে মাতঃ, করিছ ক্রন্দন।
        জগতের মহাগতি, রোধ করো মাতা
        জানি না মনের সুখ, সন্তোষ কেমন?
        ধূ ধূ করে নিরবধি, স্বজন বিরাগে
        সূতপুত্র কবে সবে, তবু দিবানিশি।
        ভিক্ষাপাত্র মাতা তব, শুণ্য নাহি গেলো।
        আর কোন্ অভিলাষ, করো মোর কাছে?
        শীঘ্র করি কহ মাতঃ, এই মোর পাশে।
        কজ্জল জীবন মোর, হোক অবসান 
        নয়তো অর্জুন দেবে, মূল্যবান প্রাণ,
        পরিনতি যাই হোক, পঞ্চ পাণ্ডবের
        কর্ণ হবে প্রতারক, ঘোর মহাপাপী
        নিজ হাতে নিজ ভ্রাতা, করিবে সংহার।

কুন্তী- হায় কৃষ্ণ বিধাতার, একি পরিহাস 
         দুষ্ট বুদ্ধি দুরাচার , পুত্র দুর্যোধন
         কোন্ পয়োধর জমে, তোমার অন্তরে
         সব শেষ করিবার, এ ছিল উপায়?
         পাচঁটি গ্রামের মাটি, এত প্রয়োজন?
         তাও তুমি মুক্ত হস্তে দিতে নাহি পারো
        একবার চেয়ে দেখো, বড় সমাদরে
         ঘোর অমানিশা ধায়, কুলেতে তোমার।
         প্রফুল্ল কোমল পাঁচ,ভ্রাতা কিছু চায়।
         কত রক্তপাত হবে, কত বংশ লোপ
         যে বাগান ভেঙে ফেলো অনায়াসে তুমি
         সেই উপবনে ফুল, ফুটিয়েছি আমি।
         যার দিকে বাণ মেরে, যমে দেবে ফাঁকি
         সেই বাণ নিজ দেহে, বিঁধিবে কাণ্ডারী। 

                             সমাপ্ত



Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ