ফটো
১৮২৬ সালে নিজের ছাদ থেকে একটা ফোটো তুলতে নিপসের লেগেছিল প্রায় চার ঘণ্টা। ভাবা যায়!!
তার কিছুদিন পরে, ১৮৩৯ সাল। ফিলাডেলফিয়ার অ্যামেচার রসায়নবিদ তথা ফটোগ্রাফার রবার্ট কর্নেলিয়াস নিজের বাড়ির মুদি দোকানের পিছনে একটা ক্যামেরা বসিয়ে, তার ঢাকনা খুলে ছবি তোলার প্ল্যান করলেন। কিন্তু কি মুশকিল! সে সময় বাড়িতে কেউ নেই। অগত্যা ঢাকনা খুলেই ক্যামেরার সামনে ঠায় এক মিনিট পাথরের মতো বসে থাকলেন তিনি। তারপর লেন্স বন্ধ করে ছবি ডেভেলপ করে দেখলেন দিব্যি এসেছে তার ছবি। দাগেরোটাইপ সেই ছবির পিছনে তিনি লিখলেন “The first light Picture ever taken. 1839.” পৃথিবীর প্রথম সেলফি।
এই দাগেরোটাইপ ছবির আবিষ্কার করেন ফরাসি দেশের জে এম দেগারে। এই পদ্ধতিতে রুপোর প্রলেপ দেওয়া পাতের উপর ছবি তোলা হত। তাই রুপো খসে গেলে ছবিও নষ্ট হয়ে যেত। ক্যালোটাইপ পদ্ধতির আবিষ্কারক ট্যালবটের সে সমস্যা ছিল না। তাঁর নেগেটিভ থেকে ইচ্ছেমতো পজিটিভ বানানো যেত।
তখন ছবি তোলা রীতিমতো এক ঘটনা ছিল। একটুও নড়লেই ছবি খারাপ হয়ে যাবে। তাই স্ট্যান্ড থাকত, যাতে গলা মাথা সব আটকে ছবি তোলা হত। এক একটা ছবি তুলতে আধ ঘণ্টা লাগত।
বাংলায় ছবি তোলার প্রচলন মোটামুটি উনিশ শতকের মাঝামাঝি। ১৮৪৮ সালের ২ নভেম্বর ইংলিশম্যান পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়-
The Englishman reports that a Mr Schranzho-fer has arrived in Calcutta and intends practising Photography upon the system invented by Mr Talbot, and to which he gave the name Calo-type. The portraits are in many particulars supe rior to those taken by the Daguerreotype, and it is asserted that a method has been invented which renders them more durable than the or ginal inventor was able to effect. Wednesday, Nov. 1.
এটিই কলকাতার প্রথম ফটো তোলার দোকান। হুজুগে বাঙালির এই নেশা ধরতে বেশি সময় লাগল না। আদীশ্বর ঘটক মল্লিক আর্ট প্রেস থেকে প্রকাশিত তার বিখ্যাত গ্রন্থ "ফটোগ্রাফি শিক্ষা" তে তখনকার ফটো তোলা নিয়ে নানা কথা লিখে গেছেন। দুই একটি বলি-
"আমরা স্কুলে পড়িবার সময় বই কিনিতে চীনাবাজারে গিয়া, ওই প্রকার একখানি গ্লাস পজিটিভ তুলিয়া আনিয়াছিলাম। যে ফটোগ্রাফার তাহা তুলিয়াছিল, সে তখন যুবাপুরুষ ছিল। তখন তাহার পোশাক-পরিচ্ছদে একটু চাকচিক্যও দেখিয়া ছিলাম। তাহার প্রায় পঁচিশ বৎসর পরে দৈবাৎ একদিন রাধাবাজারের কোণে একটি সিঁড়ির ধারে দেখিলাম যে, একজন শীর্ণকায় পক্ককেশ বৃদ্ধ একখানি গ্লাস পজিটিভ হাতে করিয়া 'ফটোগ্রাফ' 'ফটোগ্রাফ' করিয়া চেঁচাইতেছে।... আগে ছিল আট আনা ও চারি আনা, এখন হইয়াছে, চারি আনা ও দুই আনা। আমি তাহার কর্মস্থলের ছাতের উপর গিয়া নিজেরাই কয়েকখানা গ্লাস পজিটিভ উঠাইলাম। বৃদ্ধ ফোটোগ্রাফারকে কোনোমতেই বুঝিতে দিলাম না যে, আমি ফোটোগ্রফি কিছু জানি, অথবা ইহার ব্যাবসা করি" এর পরে তিনি নিজের স্টুডিও খুলে দাগারোটাইপ ও কলোটাইপ ছবি তুলতে থাকেন। নব্য ছবি তুলিয়েদের প্রতি তাঁর উপদেশ "সাধারণ চেয়ারের বদলে ঘোরবর্ণের রেশমের গদিযুক্ত চেয়ারে বসিয়ে ফোটো তুললে ভালো দেখায় ঠিকই, কিন্তু যে জাতি যেভাবে উপবেশনাদি করেন, তত্তৎ জাতীয় লোককে সেইভাবে বসাইয়া ফোটোগ্রাফ লইবে। সাহেবদের আসনে বসাইয়া এবং একটা ধাঙড়কে চেয়ারে বসাইয়া ফোটো লইলে, তাহা কেহ ভালো বলিবে না। সেই মতো অন্তঃপুরবাসিনী বাঙালি মেয়েকে চেয়ারে বসাইয়া ফোটো লইলেও তাহা অস্বাভাবিক দেখাইবে"
সিদ্ধার্থ ঘোষ তাঁর "ছবি তোলা- বাঙালির ফটোগ্রাফি চর্চা" বইতে লিখেছেন "
কলকাতায় স্থাপিত কমার্শিয়াল স্টুডিয়োর মধ্যে প্রথম ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করে জে ডব্লিউ নিউল্যান্ডের 'দাগ্যারিয়ান গ্যালারি'। ১৮৫১ থেকে নিউল্যান্ড সুদীর্ঘকাল 'দাগ্যারোটাইপ' চর্চায় নিযুক্ত ছিলেন। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের একমাত্র চিত্রটি তিনি তুলেছিলেন। পাইকপাড়ার ছোটো রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহও তাঁর কাছে এই বিদ্যা শিক্ষা করেন। কলকাতায় বাঙালিদের মধ্যে নীলমাধব দে প্রথম স্টুডিয়ো স্থাপন করেন ১৮৬২-তে 'দা বেঙ্গল ফোটোগ্রাফার্স।'
১৮৫৬-র ২ জানুয়ারি কলকাতায় 'ফোটোগ্রাফিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল' প্রতিষ্ঠিত হলে, রাজেন্দ্রলাল মিত্র নিযুক্ত হন অবৈতনিক সেক্রেটারি। দ্বিতীয় বর্ষে তিনি ট্রেজারার পদ গ্রহণ করেন আর পাইকপাড়ার ছোটো রাজা অন্যতম ভাইস প্রেসিডেন্ট। কানাইলাল দে, প্রিয়নাথ শেঠ, গৌরদাস বসাক, গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ খ্যাতনামা ব্যক্তি-সহ বহু বাঙালি সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন সোসাইটির সঙ্গে। কিন্তু ১৮৫৭-র ৬ এপ্রিল টাউন হলে 'ব্ল্যাক অ্যাক্ট'-এর সমর্থনে বক্তৃতাদানের 'অপরাধে' শ্বেতাঙ্গরা রাজেন্দ্রলালকে চরম অপমানজনকভাবে ও অগণতান্ত্রিক উপায়ে সোসাইটি থেকে বহিষ্কৃত করার পর থেকেই এই সোসাইটির সঙ্গে বাঙালিদের সংস্রব প্রায় সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়। প্রায় তিরিশ বছর পরে 'ফোটোগ্রাফিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া' নামে সংস্থাটি পুনরুজ্জীবিত হলে কয়েকজন ভারতীয় আবার তার সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ত্রিপুরার বড়োঠাকুর সমরেন্দ্রচন্দ্র দেববর্মন, মহারাজ প্রদ্যোতকুমার ঠাকুর, শরৎচন্দ্র সেন, প্রভাতকুসুম রায়চৌধুরী ও আর্যকুমার চৌধুরী প্রমুখ। আর্যকুমার প্রথম ভারতীয়, যিনি সোসাইটির বার্ষিক প্রদর্শনীতে ১৯১৩-য় বেস্ট অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন।
পূর্ব ভারতে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কলকাতার বাইরে ফোটোগ্রাফিচর্চার প্রধান কেন্দ্র ছিল ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা। ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের ফোটোগ্রাফির প্রতি আসক্তি কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিল। দাগ্যারোটাইপ, ওয়েট প্লেট, ড্রাই প্লেট-ফোটোগ্রাফির আধুনিকতম পদ্ধতির সঙ্গে সংগতি রেখেই থামেননি তিনি, গ্রন্থে ফোটোগ্রাফের প্রতিচ্ছবি ছাপার জন্য হাফটোন পূর্ববর্তী যুগে রাজপ্রাসাদে ক্যালোটাইপ প্রেস স্থাপন করেছিলেন। প্রতি বছর তাঁর আমলে রাজপ্রাসাদে ফোটোগ্রাফিক প্রদর্শনী হত। মহারানি মনোমোহিনীকেও ফোটোগ্রাফি-চর্চায় উৎসাহিত করেন তিনি। মহারাজা বীরচন্দ্রের দ্বিতীয় পুত্র বড়োঠাকুর সমরেন্দ্রচন্দ্রের ফোটোগ্রাফ দেশে-বিদেশে অজস্র প্রতিযোগিতায় বারংবার পুরস্কৃত ও প্রশংসিত হয়েছে।
রয়াল ফোটোগ্রাফিক সোসাইটির প্রথম ভারতীয় সদস্য মহারাজ প্রদ্যোতকুমার ঠাকুর। ১৮৯৭-এ তিনি সাধারণ সদস্য ও ১৮৯৮-এ 'ফেলো' মনোনীত হয়েছিলেন। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক ফাদার লাফোঁর সহযোগিতায় প্রদ্যোতকুমার ১৮৯৭ সালে কলকাতায় গভর্নর জেনারেল এলগিনের ডান হাতের এক্স-রে ছবি তুলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন। প্রদ্যোতকুমারের আরেকটি কৃতিত্ব ১৮৯৯-এ 'কালার ফোটোগ্রাফি' প্রদর্শন। 'ক্রোমোস্কোপ' নামে এক প্রজেক্টরের সাহায্যেই সম্ভবত একই ছবি তিনটি রঙে যুগপৎ প্রক্ষেপ করে এই রঙিন চিত্র প্রদর্শিত হয়েছিল।
রয়াল ফোটোগ্রাফিক সোসাইটির দ্বিতীয় ভারতীয় সদস্য সুকুমার রায় ও তাঁর পিতা উপেন্দ্রকিশোর উভয়েই দক্ষ ফোটোগ্রাফার। তবে ফোটোগ্রাফিতে তাঁদের মুখ্য অবদান হাফটোন-ব্লক নির্মাণের অঙ্গীভূত প্রসেস ক্যামেরা সংক্রান্ত মৌলিক গবেষণা। ইউরোপের মুদ্রণজগতে সেকালে বাইবেলরূপে উক্ত পেনরোজ অ্যানুয়েল পত্রিকায় ১৮৯৭ থেকে ১৯১১-র মধ্যে উপেন্দ্রকিশোরের ন-টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত ও উচ্চপ্রশংসিত হয়। সুকুমার রায়েরও দু-টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল এই পত্রিকায়। ফোটো-মাইক্রোগ এাফি বা অণুবীক্ষণের সাহায্যে ক্ষুদ্র বস্তু বা প্রাণীর ফোটো তোলার কাজেও উপেন্দ্রকিশোর ও সুকুমারের সাফল্যের প্রমাণ রয়েছে সন্দেশ পত্রিকার পাতায়"
চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাসাগরের জীবনীতে লিখছেন "পিতামাতাকে কলিকাতায় আনাইয়া [বিদ্যাসাগর] জননীকে বলিলেন-'মা। পাইকপাড়া রাজাদের বাড়িতে একজন খুব ভালো পোটো এসেছে [হডসন], তাঁহার দ্বারা তোমার একখানি ছবি তুলাইয়া লইতে চাই।' তখনকার দিনের বাংলা সাহিত্যেও বারবার ফটোগ্রাফি উঁকি দিয়েছে। সব বাদ দিলেও চোখের বালিতে-তো মহেন্দ্র বিনোদিনীর ঘনিষ্টতার শুরুই হয়েছিল ফটোগ্রাফি দিয়ে-
"হঠাৎ মহেন্দ্রের ফোটোগ্রাফ অভ্যাসের শখ চাপিল। পূর্বে সে একবার ফোটোগ্রাফি শিখিতে আরম্ভ করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছিল। এখন আবার ক্যামেরা মেরামত করিয়া আরক কিনিয়া ছবি তুলিতে শুরু করিল। বাড়ির চাকর-বেহারাদের পর্যন্ত ছবি তুলিতে লাগিল।
আশা ধরিয়া পড়িল, চোখের বালির একটা ছবি লইতেই হইবে। ...মহেন্দ্র পা টিপিয়া টিপিয়া ক্যামেরা আনিল। কোন দিক হইতে ছবি লইলে ভালো হইবে, স্থির করিবার জন্য বিনোদিনীকে অনেকক্ষণ ধরিয়া নানাদিক হইতে বেশ করিয়া দেখিয়া লইতে হইল। এমনকী, আর্টের খাতিরে অতি সন্তর্পণে শিয়রের কাছে তাহার খোলা চুল এক জায়গায় একটু সরাইয়া দিতে হইল-পছন্দ না হওয়ায় তাহা সংশোধন করিয়া লইতে হইল।...
...অবশেষে যেই ছবি লইবার জন্য ক্যামেরার মধ্যে কাচ পুরিয়া দিল, অমনি যেন কিসের শব্দে বিনোদিনী নড়িয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল" বাকিটা সবার জানা।
প্রায় একই সময়ে ফোটোগ্রফিচর্চার প্রসার অনুপ্রাণিত একটি কৌতুক-কাহিনি ফেঁদেছিলেন 'ডমরু'-স্রষ্টা ত্রৈলোক্যনাথ:
হৃষীকেশ রায় কলকাতার আর্ট স্কুলে অধ্যয়ন করেন। এই বিদ্যালয়ের বালকেরা ছবি আঁকিতে শিক্ষা করে। ছবি আঁকা ভিন্ন হৃষীকেশ ফেটোগ্রাফ অর্থাৎ আলোকযন্ত্রের সহায়তায় মানুষের চেহারা ভুলিতে শিক্ষা করিয়াছিলেন।...
নিকটস্থ কোনো গ্রামের একজন লোক তাঁহার শিশুপুত্রের ছবি তুলিবার নিমিত্ত হৃষীকেশকে অনুরোধ করিয়াছিলেন। হৃষীকেশ চাকরের দ্বারা প্রথম চেহারা তুলিবার যন্ত্র ও ছবি আঁকিবার দ্রব্যাদি পূর্ণ বাক্স প্রভৃতি পাঠাইয়া দিলেন। তাহার পর বৈকাল বেলা নিজে বাই সাইকেলে অর্থাৎ চাকায় চড়িয়া সেই গ্রামে গমন করিলেন।
যথারীতি বালককে বসাইয়া যন্ত্রনিহিত কাচের উপর হৃষীকেশ বালকের ছায়া গ্রহণ করিলেন। কীরূপ ছবি উঠিল দেখিবার নিমিত্ত যন্ত্র হইতে কাচখানি তিনি অতি সাবধানে বাহির করিলেন। আশ্চর্য! কাচের উপর বালকের মুখশ্রী অঙ্কিত হয় নাই। কাচের উপর এক পরমাসুন্দরী বালিকার প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে"
আর আগ বাড়াবো না। আজ বিশ্ব ফটোগ্রাফি দিবস। ডি এস এল আর থেকে সাধারণ মোবাইলে ছবি তোলা সকল ফটোগ্রাফারদের শুভকামনা। সঙ্গের ছবিটি উনিশ শতকের শেষদিকে তোলা এক বাঙালি দম্পতির ফটোগ্রাফ। রাধাবাজার স্টুডিয়ো-তে তোলা।
Comments
Post a Comment