শর্মিষ্ঠা নাটক

শর্মিষ্ঠা নাটক

প্রথমাঙ্ক
প্রথম গর্ভাঙ্ক
হিমালয় পর্বত-
দূরে ইন্দ্রপুরী অমরাবতী

(দুইজন দৈত্য  যুদ্ধবেশে।)

দৈত্য-১। 
বলশালী দৈত্যরাজ পর্ব্বতপ্রদেশে
তাঁর আদেশানুসারে ইন্দ্রপুরী দ্বারে 
বাস কচ্যি বহুদিন গুপ্তচর বেশে ।
দিবারাত্র চোখ রাখি দেবতা নগরে।

দৈত্য -২।
ক্ষণকাল স্বচ্ছন্দে না থাকি, ভয়ে ভয়ে।
দেবতারা যে কখন, কি করে, হঠাৎ।
সহসা যদি নির্গত হয়, সৈন্য লয়ে।
সংবাদ তার দিতে হবে তৎক্ষণাৎ।

দৈত্য -১। 
দৈত্যভূমি যে নিতান্ত রম্য রমণীয়।
স্থানে স্থানে তরুশাখা বিহঙ্গমগণ ।
মধু-স্বরে গান করে; হই পুলকীয়।
বিবিধ বনকুসুম বিকশিত বন।

দৈত্য -২।
শুধুই কি এই? আছে পুষ্প পারিজাত।
মৃদু মন্দ পুষ্প ঘ্রাণ, পবন সঞ্চার।
মধুর মধুর সুরে, কেটে যায় রাত।
সঙ্গীত কর্ণকুহরে, শীতল বিহার।

দৈত্য -১।
কোথাও ভীষণ হিম হিংস্র সিংহ-নাদ, 
কোথা ব্যাঘ্র মহিষাদি, ভয়ঙ্কর শব্দ, 
পর্বতনিঃসৃতা নদী, প্রস্তরে বিবাদ।
উচ্ছ্বাস ধ্বনি বাতাস করিতেছে জব্দ।

দৈত্য -২।
কি আশ্চর্য্য! এ স্থানের গুণে অবনত।
স্বর্গের সুখে স্বজন, মুক্ত পরিবেশে।
তবু কেন পাহারায়, থাকি অবিরত।
অহো! কার কার যেন পদশব্দ ভাসে।

দৈত্য -১।
হ্যাঁ তাই তো কার, কার পদশব্দ আসে?
শত্রু, নাকি মিত্র, তাও করি অনুমান।
প্রস্তুত থেকো সৌহার্দ্য, অসি রেখো পাশে।
এ কোন সামান্য ব্যক্তি না, আছে প্রমাণ।
এর পদভরে পৃথী, যেন কম্পমানা।
ওই, ওই শোনো শব্দ যেন চেনা চেনা।

(বকাসুরের প্রবেশ।)


বক। 
কি খবর হে সৈনিক সব কুশল তো?
দৈত্যপতি, আমি তাঁর এক অনুচর।
নাম বকাসুর, সীমা সু- সুরক্ষিত তো?
রণসজ্জায় সজ্জিত রবে দিনভর।

দৈত্য-১ (সচকিতে) 
ওহে মহাশয়, আজ্ঞা হউক আসতে। 
সবিনয় নমস্কার লবে দৈত্যবর।
পথ অতিক্রমে ক্লান্ত, এত দূর হতে 
অশ্ব পৃষ্ঠে পরিশ্রম, পড়িছে নজর।

বক। 
ক্লান্ত, তবে দৈত্যবর, বলো কি সংবাদ?
ইন্দ্রপুরীর দেবতা, যে বড় চতুর ।
মিষ্ট বাক্যে ছলেবলে, বাঁধাবে বিবাদ।
ইন্দ্রপুরী বর্তমানে বড়ই নিষ্ঠুর।

দৈত্য ২। 
এ স্থলের বর্তমানে সকলি মঙ্গল। 
এদ্দুরে এই নির্জনে, তব আগমন।
দৈত্যপুরী কুশলতো ওহে মহাবল?

বক। 
ভাই, তার আর খুলি, কিবা আবরণ?
অদ্য দৈত্যকুল এক প্রকার অস্থির।

দৈত্য-১। 
কেন কেন, মহাশয়? কিবা অঘটন?
কার এত দুঃসাহস? করিল অস্থির?
দৈত্য পুরীর অঙ্গনে কার আগমণ?

বক। 
মহাঋষি শুক্রাচার্য্য, যিনি দৈত্যগুরু,
ক্রোধে অন্ধ হয়ে তিনি, এই দৈত্যদেশ
ত্যাজিতে উদ্যত হন, দৈত্য মহাগুরু।
লয় বুঝি হয় এই, দৈত্য পরিবেশ।

দৈত্য-২ 
কি সর্বনাশ! এ কি অদ্ভুত ব্যাপার, 
এর কি কারণ হলো জানিতে কি পারি?
কি কারণে এমন, সিদ্ধান্ত তাহার।
গুরুবিনা রক্ষকুল, করে মাধুকরী।

বক
ভাই, স্ত্রীজাতি সর্ব্বত্রে বিবাদের মূল। 
দৈত্যরাজকন্যা তিনি রুদ্রাণী শর্মিষ্ঠা।
গুরুকন্যা দেবযানী, অত্যন্ত প্রতুল।
তার সহিত কলহ, করিল প্রতিষ্ঠা।
তাঁকে অন্ধকার কূপে করিয়া নিক্ষেপ।
অনাদরে পাড়ি দিল, আপনার গৃহে।
দেবযানী এই কথা করিয়া আক্ষেপ,
আপন পিতারে তাহা, ভয়ে ভয়ে কহে ।
ক্রোধে প্রজ্বলিত গুরু, হুতাশন ন্যায় 
জ্বলিয়া ওঠেন তিনি, মহাদেব যথা।
আঃ! সে ব্রহ্মাগ্নিতে বুঝি, সব পুড়ে যায়।
দেবাদিদেব মহেশ, বুঝিলেন ব্যথা।

দৈত্য-১
আজ্ঞে তার সন্দেহ কি! কিন্তু গুরুকন্যা?
সে তো শর্মিষ্ঠার অতি, প্রিয় স্নেহধন্যা।
কিসের কলহ তার, তাতো অসম্ভব।
প্রাণস্বরূপার সনে কি করিল সব?

বক। 
হাঁ যথার্থ বটে, কিন্তু ভাই উভয়েই 
নবযৌবন-মদে, উন্মত্তা দুজনেই

দৈত্য-২
তারপর? তারপর কি হলো তখন?
কি করিল ক্রোধাম্বিত ঋষিবর তবে?
রাজ্য বুঝি ছাড়িলেন ক্রোধী তপোধন 
এমনি অনিষ্ট কিছু, ঘটাইল তবে।

বক। 
না না তেমন তো নয়, এও একেবারে।
মহাঋষি শুক্রাচার্য্য, অগ্নিসমক্রোধে।
মুক্তকণ্ঠে কহে তিনি, রাজ দরবারে।
ওরে রাজা নরাধম, কহে বিনা বোধে।
এইক্ষণে পরিত্যাগ করি রাজ সভা।
এই পাপনগরীতে নাই মোর স্থিতি 
কাঁপিল স্বভূমি আর জ্বলে অগ্নি প্রভা।
ঋষির গর্জনে কাঁপে, শান্ত এই ক্ষিতি।

সকল মস্তকে যেন হলো বজ্রপাত।
দিনের আলোয় ভাসে, নিশি অন্ধকার।
সকলে ভয়ে বিস্ময়ে, করে প্রনিপাত।
স্পন্দহীন হয়ে রহে, প্রস্তর আকার।

দৈত্য-১।
তারপর মহাশয়? কি হলো বলুন

বক। 
তারপরে মহারাজ কৃতাঞ্জলিপুটে 
বহু স্তব করে বলে, ওহে গুরুদেব।
কি অপরাধে আমারে, শাস্তি দেন বটে।
সবংশে নিধন করে, মুক্তি দেন দেব।
তাও যদি না পারেন, দেন অভিশাপ।
বিকলাঙ্গ হয়ে যাই, মোরা পরিবারে।
আপনার ক্রীতদাস, হয়ে কাটি তাপ।
নাহি ছাড়ি যান মোরে, আপন বিচারে।
আপনার প্রসাদেই  সকল সম্পত্তি! 
আপনার অনুগ্রহে আমি অধিপতি।
কন্যার দুর্মতি হলো, আসিল বিপত্তি।
ক্ষমা ক্ষমা ক্ষমা করো ওহে মহামতি।

দৈত্য-২
তারপর তারপর কি হইল বটে।
দৈত্যগুরু অভিশাপ দিয়েছিল নাকি?

বক।
তারপরেই উত্তরে মহর্ষি বল্লেন, 
সে কি মহারাজ, তুমি দৈত্যকুলপতি, 
জগৎ সংসার সব, পদতলে নেন।
আমি হই ভিক্ষাজীবী, সাধারণ অতি।
আমার প্রতি তোমার, এই আচরণ?
রাজা তাতেও কাতর হয়ে, কহিলেন
এই ভয়ানক ক্রোধ, কিসের কারণ?

দৈত্য।

তা মহর্ষি এ কথায় কি আজ্ঞা করেন?

বক। 
রাজার নম্রতা দেখে মহর্ষি তখন
ভূতল হতে রাজনে উত্থিত করেন, 
কহেন আক্ষেপে তারে সকল বৃত্তান্ত
আপনার কন্যা রাজা অতীব দুরন্ত 
বিনা অপরাধে তারে, করিল নিক্ষেপ।
জল শূন্য, কুয়োয় ফেলে, নাই ভ্রুক্ষেপ।
নাহি ক্ষমা নাহি খেদ আসিল ফিরিয়া।
দেবযানী কন্যা মোর কহিল কাঁদিয়া।
অতি স্নেহপাত্রী মোর, ওহে মহা প্রাণ।
কেমনে রহিব আমি, হলে অপমান।

রাজা এ কথায় বিস্ময়াপন্ন হয়ে, 
করযোড় করে এই উত্তর দিলেন, প্রভো! আমি এ কথার বিন্দু বিসর্গও জানি নে, তা আপনি সে পাপশীলা শর্মিষ্ঠার যথোচিত দণ্ড বিধান করে‍্য ক্রোধ সম্বরণ করুন, নগর পরিত্যাগের প্রয়োজন কি?

দৈত্য। ভগবান্ ভার্গব তাতে কি বল্যেন?

বক। তিনি বল্যেন, এ পাপের আর প্রায়শ্চিত্ত কি আছে? তোমার কন্যা চিরকাল দেবযানীর দাসী হয়ে থাকুক, এই আমার ইচ্ছা।

দৈত্য।

উঃ! কি সর্বনাশের কথা!

বক। মহারাজ এই বাক্য শুনে যেন জীবন্ম, তের ন্যায় হলেন। তাতে মহর্ষি সক্রোধে রাজাকে পুনর্ব্বার বলেন, রাজন্! তুমি যদি আমার বাক্যে সম্মত না হও, তবে বল আমি এই মুহূর্তেই এ স্থান হতে প্রস্থান করি। মহর্ষি ভার্গবকে পুনরায় ক্রোধান্বিত দেখ্যে মন্ত্রিবর কৃতাঞ্জলিপূর্ব্বক মহারাজকে সম্বোধন করে বলেন, মহারাজ! আপনি কি একটি কন্যার জন্যে সবংশে নির্বংশ হবেন? দেখুন দেখি, যদি কোন বণিক্ সুবর্ণ, রৌপ্য, ও নানাবিধ মহামূল্য রত্নজাত-পরিপূর্ণ একখানি পোত লয়ে সমুদ্রে গমন করে, আর যদি সে সময়ে ঘোরতর ঘনঘটাদ্বারা আকাশমণ্ডল আবৃত হয়ে প্রবলতর ঝটিকা বইতে থাকে, তবে কি সে ব্যক্তি আপনার প্রাণরক্ষার নিমিত্তে সে সময়ে সে সমুদায় মহামূল্য রত্নজাত গভীর সমুদ্রমধ্যে নিক্ষেপ করে না?

দৈত্য।

তার পর মহাশয়?

বক। দৈত্যাধিপতি মন্ত্রিবরের এই হিতকর বাক্য শুনে দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করে রাজকুমারীকে অগত্যায় সভায় আনয়ন করতে অনুমতি



Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ